আফিয়া সুলতানা: অনুকরণ মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু নেতিবাচক অনুকরণ প্রবণতার পরিণতি যেকোনো জাতির জন্য অশনিসংকেত। এমনি এক অশনিসংকেত দিচ্ছে বিভিন্ন ক্রাইম সিরিজ, থ্রিলার সিরিজ, সাইকো থ্রিলার সিরিজ, ক্রাইম পেট্রোল, সিআইডি দেখে অপরাধ প্রবণতার বৃদ্ধি। এসব সিরিজ ও মুভি যেন ক্রাইমকে নিত্যদিনকার সাধারণ ঘটনায় পরিণত করেছে। এসব মুভি-সিরিজে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে কীভাবে ক্রাইম করতে হয় আবার ক্রাইম লুকাতে হয় তা দেখানো হয়। বিগত কয়েকটি বছরের বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করলে এসব ক্রাইমাল মুভি ও সিরিজের ভয়াবহতা বুঝতে পারা যায়।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে ছয় বছর বয়সী শিশু আয়াতের নিখোঁজ হওয়ার ১০ দিন পর মিলে তার খণ্ডিত লাশ। এই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আসামি বাড়ির সাবেক ভাড়াটিয়া আবির আলী। সে মুক্তিপণের জন্য অপহরণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মরাদেহ ছয় টুকরা করে তা টার্মিনাল এলাকায় সাগর পাড়ে ফেলে দেয়। পুলিশ সুপার জানান, হিন্দি সিরিয়াল ক্রাইম পেট্রোল ও সিআইডি দেখে ৬ মাস আগে থেকে অপহরণের পরিকল্পনা করে আবির। চলতি বছরের ১৮ মে ভারতের লিভ-ইন পার্টনার শ্রদ্ধা ওয়াকার (২৬)কে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার পর তার মরাদহ ৩৫ টুকরো করে আফতাব আমিন পুনওয়ালা (২৮)। তারপর মরাদেহ রাখার জন্য ৩০০ লিটারের একটি ফ্রিজ কিনে ১৮ দিনে মেহরাউনি জঙ্গলের বিভিন্ন এলাকায় টুকরাগুলো ফেলে আসেন আফতাব। আফতাব আমেরিকার জনপ্রিয় অপরাধমূলক ওয়েব সিরিজ ডেক্সটার দেখে লিভ-ইন সঙ্গীকে খুনের পরিকল্পনা করেছিলেন। এমনকি গুগলে সার্চ করে মানবদেহ টুকরা করে কাটা এবং রক্তের দাগ পরিষ্কারের পদ্ধতি খুঁজেছিলেন আফতাব। তিনি খুনের আগে একাধিক অপরাধমূলক ছবি ও ওয়েব সিরিজ দেখে পরিকল্পনা করেছিলেন। ২০২২ সালেই ঘটে আরেক চাঞ্চল্যকর প্রতিশোধ । বলাৎকারের প্রতিশোধ নিতে ক্রাইম পেট্রোল দেখে হত্যার পরিকল্পনা করে আসামি আদনান সিয়াম। যিনি শাহাদাত নামে এক ব্যবসায়ীর বলাৎকারের শিকার হয়ে আসছিলেন। ২০২২ সালের ১০ জুলাই বানেশ্বর ইউনিয়নের শিবপুরহাট গ্রামের নিজ বাড়িতে তাকে হত্যা করেছিলেন। ২০২২ সালে ২২ সেপ্টেম্বর ক্রাইম পেট্রোল দেখে নোয়াখালীতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তাসনিয়া হোসেন অদিতা (১৪)কে হত্যার পরিকল্পনা করেন অদিতার সাবেক কোচিং শিক্ষক রনি। জবানবন্দিতে রনি নিজেই বলেন ভারতীয় টিভি ধারাবাহিক ক্রাইম পেট্রোল দেখে পরিকল্পনা করে অদিতাকে হত্যা করেন। এর আগে পিরোজপুরের ইন্দুকানিতে সালাউদ্দিন (১৩) নামে রাজলক্ষ্মী স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে হত্যা করে একটি কিশোর গ্যাং। সালাউদ্দিনকে পটকা ফাটানোর কথা বলে নিয়ে গিয়ে কমলপানীয়র সঙ্গে নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করায় এবং একপর্যায়ে অচেতন হলে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ খালে ফেলে দেয়। আটকের পর এক কিশোর জানায়, সে ভারতীয় টেলিভিশনের প্রচারিত ধারাবাহিক ক্রাইম পেট্রোল দেখে হত্যা ও মুক্তিপণ আদায় করার পরিকল্পনা করে। সালাউদ্দিনের বাবা ৬ লাখ টাকার জমি বিক্রি করে যা শুনে মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা আসে। ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় ভারতীয় সিরিয়াল (ক্রাইম পেট্রোল) দেখে মো. আরাফাত (১২) নামের পঞ্চম শ্রেণির এক শিশুকে হত্যার চেষ্টা করে তার তিন সহপাঠী। আখক্ষেতে নিয়ে গিয়ে হত্যার চেষ্টা করে কিন্তু দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টা পরে থাকার পরও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় সে। তার মাথার মগজ বেরিয়ে যায় এবং কান কেটে যায়। একজোড়া রোলার স্কেটস আরাফাত তার বন্ধুর কাছে বিক্রি করে। তার বন্ধু সম্পূর্ণ টাকা না দিতে পারায় তার বন্ধু অন্য বন্ধুদের নিয়ে ক্রাইম পেট্রোলের মতোই হত্যার পরিকল্পনা করে। মাত্র ২ হাজার ৫০০ টাকার কাছে পঞ্চম শ্রেণির শিশুরাও হয়ে যায় আসামি। ২০১৯ সালের শুরুতে চট্টগ্রাম নগরীতে আকবর শাহ এলাকায় ভাবি হাসিনা বেগম (৩২ )কে হত্যা করে বিভিন্ন সময়ে টাকা চেয়ে না পাওয়ায় দেবর লিমন। রিমান্ডে আসামি লিমন জানান, নিয়মিত ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ক্রাইম পেট্রোল থেকে খুনের পরিকল্পনা মাথায় আসে। অনেক আগে থেকেই ক্রাইম সিরিজের প্রভাব পড়ছে শিশু-কিশোর-যুবক থেকে বৃদ্ধ বয়সীদের মধ্যে। ২০১৬ সালে ও হত্যাকাণ্ডের জন্য আদালতের মাধ্যমে এক যুবককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তার মা বাবাকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। চার বছর বয়সী শিশু আবতাহী আন রশিদকে অপহরণ করার পর মেরে বস্তাবন্দি করে ঘরের মাচার ওপর রাখেন। এতে তার মা-বাবার সহায়তা করেন। সে ক্রাইম পেট্রোল শো দেখে স্বল্প সময়ে বড়লোক হতে শিশু পিতার কাছে ৩০ লাখ টাকা দাবি করে।
শুধু হত্যাই নয়, অন্যান্য অপরাধ চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ প্রবণতা ও বৃদ্ধি করেছে।
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, চুরি করার দায়ে মোহাম্মদ সোহান নামে ২৪ বছর বয়সী এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সে একটি বাসা থেকে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, এক জোড়া স্বর্ণের বালা, দুটি স্বর্ণের ব্রেসলেট, তিন জোড়া স্বর্ণের কানের দুল, ৮টি স্বর্ণের আংটি চুরি করে। এছাড়া তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় একটি বিদেশি পিস্তল, ৩০০ গ্রাম গাঁজা, নগদ ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ৩টি চাকু, ১টি ক্ষুর, ২টি স্ক্রু ড্রাইভার, দুটি রেঞ্চ, ২২টি চাবি ও স্বর্ণালঙ্কার। সোহানও ভারতীয় অপরাধ তদন্তবিষয়ক সিরিজ ক্রাইম পেট্রোল দেখে চুরির হাত পাকিয়েছেন বলে জানান।
২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের উথনী সোনালী ব্যাংক শাখায় লুটের ঘটনাও আসামি চারজন মূলহোতা সাফাতুজ্জামান রাসেল (৩৮), আখতারুজ্জামান রাসেল (৩০), মোহাম্মদ রিদয় (২২), মো. রকি (২৩), ও মফিজুল শাহ ক্রাইম পেট্রোল দেখে লুটতরাজে উদ্বুদ্ধ হন। তাদের থেকে উদ্ধার করা হয় লুটের ৮ লাখ ৮২ হাজার টাকার মধ্যে ৫ লাখ ৩ হাজার টাকা এবং লুটের কাজে ব্যবহƒত খেলনা পিস্তল, ধারালো অস্ত্র, পিপিই, মোটরসাইকেল, হেলমেট।
ধর্ষণেও ইন্ধন জোগাচ্ছে এসব অপসংস্কৃতির ক্রাইম সিরিজ। নোয়াখালীর তাসনিয়া হোসেন অদিতাকে ধর্ষণের উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন কোচিং শিক্ষক রনি ক্রাইম সিরিজের মাধ্যমে। লোমহর্ষক এক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় মাদারীপুর শহরের ৯ বছর বয়সী চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মেয়ের কাছে। সে জানায়, তার বাবা জয়নাল বেপারী ক্রাইম পেট্রোল দেখে টিভি বন্ধ করে তার পাশে ঘুমাতে যায় এবং তার মা না থাকার সুযোগে তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করে। এতেই বোঝা যায়, ক্রাইম সিরিয়াল কীভাবে একজন পিতাকেও বশ করে ফেলে।
আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে ক্রাইম সিরিজ এবং মুভি মূলত অপসংস্কৃতির প্রবেশ করিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্ররোচিত করছে শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ সবাইকে। ক্রাইম পেট্রোল বা সিআইডি ও অন্যান্য সিরিজের কল্পকাহিনী থেকে অন্যায় অপকর্মের কৌশল রপ্ত করছে মানুষ। কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে, খুনখারাবি চর্চা হচ্ছে, গৃহ বিবাদে কল্প-কাহিনীর রূপ নিচ্ছে বাস্তবিক ঘটনায়। এসব সিরিয়াল-মুভি থেকে ঘরে ঘরে বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে, পরকীয়ার চর্চা হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ কলহ সৃষ্টি হচ্ছে, লেগে যাচ্ছে বউ শাশুড়ির যুদ্ধ। এসব সিরিয়াল বিনোদনের পর্যায়কে ছাড়িয়ে নেশায় পরিণত হয়। এসব ক্রাইম সিরিজ থেকে সাধারণের ইতিবাচক শিক্ষার কিছু নেই। বরং কয়েক বছরে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, চুরির ঘটনায় পুলিশের কাছে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য, যা এসব ক্রাইম সিরিজের সঙ্গে জড়িত। বিশেষজ্ঞরা ক্রাইম সিরিজের বিরুদ্ধে একমত হয়েছেন। গবেষণায় উঠে এসেছে অপরাধ বিষয়ক তথ্যচিত্র শিশুদের মনে প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে ভালো-মন্দের বিবেচনা বোধ হারিয়ে পরিচিত করছে কিশোরদের। প্রাপ্তবয়স্করাও যুক্ত হচ্ছেন এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডে।
এসব ক্রাইম সিরিজ সামাজিক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান হিসেবে প্রচার করা হলেও এতে ইতিবাচক এর তুলনায় নেতিবাচক দিকেই মানুষ বেশি প্ররোচিত হচ্ছে। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে পুলিশের নিকট এসবের স্পষ্ট প্রভাব প্রকাশিত হলেও এসব ক্রাইম সিরিজের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। কেননা এতে অর্থনৈতিক ব্যাপার জড়িত রয়েছে। ব্যাপক জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছে এসব অতিরঞ্জিত ক্রাইম সিরিজ। এসব ক্রাইম সিরিজে দেখানো অপকৌশল সাধারণ মানুষের অজানা থাকে কিন্তু প্রতিনিয়ত দেখতে দেখতে অপরাধকে সাধারণ ঘটনা মনে করছে। এসব বিনোদনের নামে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে এখনই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্র, আইন, জনগণ, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে রুখে দিতে হবে সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির বিনোদন। বিনোদন হোক ইতিবাচক শিক্ষামূলক, নেতিবাচক ক্রাইম সিরিজ প্রচার বাতিল করা হোক।
শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়