প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

অপরিকল্পিত নগরায়ণ অনুৎসাহিত করতে গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে

রেজাউল করিম খোকন: গ্রামীণ এলাকা থেকে নগরমুখী অভিবাসনের হার যেভাবে বাড়ছে তাতে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জীবনযাপন আরও জটিলতার আবর্তে পড়ে যাবে সন্দেহ নেই। গ্রাম এবং ছোট্ট মফস্বল শহরগুলো থেকে বড় শহরে লোকজনের অভিবাসনের কারণগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক কারণটাই মুখ্য। এ ছাড়া রয়েছে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার সুযোগ লাভ। অনেক মেয়ে বিয়ের পর গ্রাম থেকে শহরে আসছে নতুন সংসার করতে। দেখা গেছে, দেশের অন্যান্য বিভাগের চেয়ে ঢাকা বিভাগে অভিবাসনের হার সবচেয়ে বেশি। তবে রাজশাহীতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। শহরমুখী গ্রামীণ জনসে াত বেড়ে যাওয়ায় শহর এলাকায় জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। শহর এবং গ্রাম এলাকায় আয়ের বৈষম্যই শহরমুখী জন¯্রােত বৃদ্ধির একমাত্র কারণ নয়। আজকাল শহরাঞ্চলে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজের কর্মক্ষমতা বাড়ানো এবং উপার্জন স্তর উন্নত করার নানা সুযোগ থাকায় গ্রাম থেকে অনেক নারী-পুরুষ শহরে পা রাখছেন। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে গ্রাম থেকে আসা অনেক নারী-পুরুষ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে মানবসম্পদ উন্নয়নের চমৎকার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বটে, তবে এর ফলে শহরগুলোয় বাড়তি জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে এটা না মেনে উপায় নেই। ছোট ছোট শহরগুলোতেও এখন গ্রামের মানুষের অভিবাসন হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী ছোট শহরগুলোর জীবন মানের তেমন উন্নয়ন ঘটেনি, অনেক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। উন্নত স্বাস্থ্য সুবিধা এবং মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ সমৃদ্ধ উপযুক্ত স্কুল-কলেজের সংখ্যা পর্যাপ্ত না হওয়ায় ছোট শহরগুলো আকর্ষণ হারাচ্ছে অনেকের। যে কারণে সেখান থেকে রাজধানী ঢাকা এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শহরে বাড়তি জনসংখ্যার চাপ দিন দিন বাড়ছে। মূলত সংলগ্ন আশপাশের ছোট জেলা-উপজেলা শহরগুলো থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন মেট্রোপলিটন শহরগুলোয় অভিবাসন ঘটছে।

দারিদ্র্য, বছরজুড়ে কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নানা বিপর্যয়, বন্যা, খরা, নদী ভাঙন প্রভৃতির শিকার গ্রামের অসহায় বিপর্যস্ত মানুষগুলো অনেকটা নিরুপায় হয়ে শহরমুখী হচ্ছে। গত কয়েক দশকে ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরে গ্রাম ছেড়ে আসা নারী-পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার প্রসার। এর ফলে খুব দ্রুত অভাবনীয় হারে কর্মসংস্থানের চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গার্মেন্টস শিল্প ছাড়াও বিভিন্ন রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানাগুলোয় শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য শ্রম চাহিদার বিকাশ ঘটেছে। সেই চাহিদা পূরণ করতে গ্রাম থেকে অনেক নারী-পুরুষ শহরে আসছে। এর বাইরেও অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চল থেকে অর্থনৈতিক সামাজিকভাবে উন্নত শহর এলাকায় যেমন ঢাকা, চট্টগ্রামে আধুনিক মানসম্মত উন্নত জীবনযাপনের আশায় তরুণ-তরুণীরা পা বাড়াচ্ছে আজকাল।

গ্রামীণ জনজীবনে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা ক্রমেই সুস্পষ্ট হচ্ছে। গ্রামগুলো আগের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে নানা কারণে। গ্রাম উজাড় হচ্ছে প্রধানত দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণে। অপেক্ষাকৃত ভালো জীবনযাপনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে নি¤œবিত্ত, দরিদ্র শ্রেণি গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে। শহরে পা রাখতে পারলে রিকশা চালিয়ে, শ্রমিক হিসেবে কাজ করে মোটামুটি ভালো উপার্জন সম্ভব। গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে কাজ করলে প্রতি মাসে নির্ধারিত বেতন পাওয়া যাবে; যা গ্রামে বসে অর্জন সম্ভব নয়। অধিকতর উপার্জনের আশায় ঢাকা, চট্টগ্রাম মহানগরী এবং আশপাশের শিল্প এলাকাগুলোয় গ্রাম থেকে আসা নারী-পুরুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। যারা গ্রামে থাকছেন, সেসব স্বচ্ছল, সামর্থ্যবান মানুষগুলো বৈদেশিক রেমিট্যান্সের অর্থেই হোক কিংবা দেশীয় আয় উপার্জনের জোরেই হোক গ্রামের ধানিজমিতে ঘরবাড়ি তৈরি করছেন। ধান, পাট, রবিশস্য চাষাবাদের বদলে জমিগুলোর রূপান্তর ঘটছে আবাসিক এলাকায়। অপরিকল্পিতভাবে তৈরি ইমারতগুলো গ্রামীণ সৌন্দর্যে অবাঞ্চিত ঝামেলা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এভাবেই বাধার সৃষ্টি হচ্ছে স্বাভাবিক জলপ্রবাহে। স্বাভাবিক জলপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়ে অকারণে অপ্রত্যাশিতভাবে প্লাবিত হচ্ছে গ্রামীণ জনপদ। এভাবেই স্বাভাবিক পলিমাটির আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষি জমিগুলো। যেখানে ধানের চাষ হতো, পাটের চাষ হতো, চাষ হতো নানারকম রবিশস্যের, সেসব ক্ষেত এখন অনুর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। আমরা নগরায়ণের বিপক্ষে নই। তবে আমাদের দাবি এবং প্রত্যাশা, পরিকল্পিত নগরায়ণ হোক বাংলাদেশে। যেখানে থাকবে প্রশস্ত রাস্তা, বিস্তৃত খেলার মাঠ, লেক, সবুজ গাছপালা, বন-বনানী সমৃদ্ধ পার্ক, সুদৃশ্য বাসযোগ্য টেকসই ইমারত, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, বিনোদনের জন্য অডিটোরিয়াম, হল প্রভৃতি। যেখানে যানজট, ভোগান্তির লোডশেডিং, বছরজুড়ে পানি সরবরাহে ঘাটতি, গ্যাস সংকট, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, দুর্গন্ধময় অস্বস্তিকর পরিবেশÑ কোনোটাই থাকবে না। বর্ষাকালে রাজপথগুলো হাঁটু ও কোমর সমান পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে না। আলো বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর দুর্গন্ধময় বস্তির বিস্তৃতি ঘটবে না যেখানে। সুস্থ সুন্দর, উন্নত আরামদায়ক জীবন সবাই কামনা করে। শহর কিংবা গ্রাম সবখানেই সুন্দর স্বাস্থ্যকর আরামদায়ক পরিবেশে স্বস্তিতে বসবাস করতে চায় সবাই। মানুষের খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার স্যানিটেশনের ব্যবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেককে দিনে একবার হলেও শৌচাগারে যেতে হয়। জাতিসংঘ বলছে, ২৪০ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যকর শৌচাগার ব্যবস্থা নেই, যাদের অধিকাংশই উন্নয়নশীল কিংবা দরিদ্র বিশ্বের।

আমাদের নাগরিক জীবনযাপনে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা হলো প্রয়োজনীয় সংখ্যক গণশৌচাগার না থাকা। এ সমস্যা নাগরিকদের প্রতিদিনই চরম অস্বস্তিতে ফেলছে। জনসংখ্যার দিক থেকে ঢাকা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম জনবহুল শহর। বন্দর নগরী চট্টগ্রামও এই সময়ে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। চাকরি, ব্যবসা, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা প্রয়োজনে ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় এক কোটি মানুষ ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে থাকে। অধিকাংশ মানুষেরই মলমূত্র ত্যাগের জন্য শৌচাগার প্রয়োজন। কিন্তু এখানে চাহিদার তুলনায় শৌচাগারের সংখ্যা খুবই কম। যেগুলো রয়েছে সেগুলোর অবস্থাও খুব খারাপ। অধিকাংশই ব্যবহার অনুপযোগী। রাজধানী ঢাকা শহরে বাড়ির বাইরে জীবিকা কিংবা অন্যান্য কাজের প্রয়োজনে বেরোনোর পর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার প্রয়োজন হলে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ গণশৌচাগার বা পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের কথা চিন্তা করতে পারেন না। এছাড়া গরিব মানুষ, বিশেষ করে বস্তিবাসী, হকার, রিকশাচালক, পরিবহন শ্রমিক, ভিক্ষুক, ভাসমান ছিন্নমূল মানুষ যারা বেশিরভাগ সময় বাইরে অবস্থান করেন তাদের জন্য এই মহানগরীতে গণশৌচাগারের কোনো ব্যবস্থাই নেই। ফলে তারা বাধ্য হয়ে ফুটপাতের পাশে, পার্কে, লেকের ধারে, সড়কের পাশে, ড্রেনে বিভিন্ন উš§ুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করছে। এতে একদিকে শহরের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। একটি রাজধানী শহরের আন্তর্জাতিক মান এভাবেই ক্ষুণœ হচ্ছে প্রতিদিন। উš§ুক্ত স্থানে বাধ্য হয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের কারণে বিব্রতকর পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন নগরবাসী মানুষদের মধ্যে অনেকেই। এরকম দু’একটি জায়গায় এখন হাঁটাচলা কঠিন হয়ে পড়েছে।

রাজধানীর কোনো কোনো জায়গায় কয়েকটি পাবলিক টয়লেট বা গণশৌচাগার রয়েছে। সিটি করপোরেশন এগুলো বাণিজ্যিকভাবে লিজ দেয়ায় ব্যবহারকারীদের ৫-১০ টাকা খরচ করতে হয়; যা সাধারণ দরিদ্র ছিন্নমূল হকার শ্রমিক ভিক্ষুক শ্রেণির মানুষদের পক্ষে দেয়া অসম্ভব। ফলে তারা নিত্যদিন উš§ুক্ত জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে শহরের পরিবেশ নষ্ট করছেন এবং সৌন্দর্যহানি করছেন। কয়েকদিন আগে এক শীর্ষ জাতীয় দৈনিকে ‘ঢাকার আদালত পাড়ায় নারী-পুরুষের জন্য একই শৌচাগার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, ঢাকার ১২৯টি আদালতে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য শৌচাগার আছে মাত্র ১০টি। এসব শৌচাগারে যেতে হলে লাইনে থাকতে হয় আদালতে আসা বিচার প্রার্থীদের। যেসব শৌচাগার আছে সেগুলোও ব্যবহার অনুপযোগী। আবার নারীদের জন্য পৃথক কোনো শৌচাগার নেই। এতে করে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় ব্যবহারকারীদের। আদালতের শৌচাগারগুলো ঘুরে দেখা গেছে এগুলো নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত। নিয়মিত পরিষ্কারও করা হয় না। তাই অধিকাংশ শৌচাগার বেশিরভাগ সময়ে ব্যবহারের অনুপযোগী থাকে। সবার অভিযোগ দুর্গন্ধের কারণে শৌচাগারে ঢোকা যায় না। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়লেও এসব শৌচাগার ব্যবহারের কথা ভাবতে পারেন না অধিকাংশ মানুষ। আদালতগুলোয় নারীদের জন্য পৃথক শৌচাগার না থাকায় নারীদের শৌচাগার ব্যবহারের ক্ষেত্রে দারুণ অস্বস্তিতে পড়তে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো শৌচাগারে হয়তো একজন নারী ঢুকছেন, তিনি ভেতরে থাকতেই বাইরে একজন পুরুষ শৌচাগারের দরজায় টোকা দিচ্ছেন। নারী-পুরুষ একই শৌচাগারে যাওয়া লজ্জাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক শৌচাগারে দরজা পর্যন্ত থাকে না, থাকলেও সেগুলো ভাঙা অবস্থায় থাকে। অনেক শৌচাগারের দরজায় ছিটকিনি নেই। এরকম অগণিত বিব্রতকর ব্যাপার প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করা যায় ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাবলিক টয়লেট বা গণশৌচাগারগুলোয়। শহরের বিভিন্ন হাসপাতালেও একই চিত্র দেখা যায় আদালতের পাবলিক টয়লেটের মতো। এ নিয়ে কয়েকটি টিভি চ্যানেলে বেশ গুরুত্ব দিয়ে সচিত্র রিপোর্ট করা হলেও কোনো প্রতিকার হয়নি। ২০১১ সালে বেসরকারি সংস্থা নগর গবেষণা কেন্দ্র পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৫৫ লাখ মানুষের গণশৌচাগার ব্যবহারের চাহিদা আছে। উত্তর-দক্ষিণ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৬৯টি গণশৌচাগার থাকলেও তার মধ্যে মাত্র ৪৭টি ব্যবহারের উপযোগী বলে ওই গবেষণায় বলা হয়।

আমরা সবাই উন্নত সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখি, সুন্দর সুস্থ জীবন যাপনের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালাই। এমনিতেই উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে ক্রমেই। আমাদের নাগরিক জীবনে অগণিত সমস্যা সংকট রয়েছে। প্রতিদিনই এসব সমস্যা সংকট মোকাবেলা করে চলতে হচ্ছে আমাদের। এই সমস্যা সংকটগুলোর মধ্যে কোনোটিই গুরুত্বহীন নয়। রাজধানী ঢাকা শহরে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট বা গণশৌচাগারের অভাবে নাগরিক জীবনে যে দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিনিয়তই মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে, শহরের সৌন্দর্য ও মর্যাদা হানি করছেÑএ ব্যাপারে চোখ-কান বন্ধ করে বসে থাকার উপায় নেই। বলা যায়, এ ক্ষেত্রে দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। এখনই সবাইকে সচেতন হতে হবে। শহরের বিভিন্ন ব্যস্ততম স্পট, শপিং মল, মার্কেট, বিভিন্ন অফিসপাড়া, বিনোদন স্পট, আদালত এলাকা, স্টেডিয়াম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাস ট্রাক ও অন্যান্য পরিবহন টার্মিনালগুলোয় আবশ্যিকভাবে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট বা গণশৌচাগারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং এগুলো পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো রকম ত্রুটি, বিচ্যুতি, গাফিলতি, অযতœ-অবহেলা দুর্নীতির প্রশ্রয় দেয়া চলবে না। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নতুন পাবলিক টয়লেট স্থাপনের পাশাপাশি এগুলোর ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে স্যানিটারি ডিপার্টমেন্টকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোকবল দিয়ে ওই ডিপার্টমেন্টকে শক্তিশালী করতে হবে। নগরীর পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। এজন্য বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী ও বিদেশি সাহায্য সংস্থার সহায়তা নেয়া যেতে পারে। বিষয়টিকে দীর্ঘদিন ধরে অনেকটা অবহেলায় পাশ কাটিয়ে চলার মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাননি। তবে এখন মাথা ঘামাতে হবে, স্বাস্থ্যসম্মত আধুনিক পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ার প্রত্যয়ে সবাইকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। এই নগরীতে পথ চলতে গিয়ে যাতে টয়লেট সমস্যার কারণে কাউকে যেন অস্বস্তিতে পড়তে না হয়, বিব্রতকর লজ্জাকর পরিস্থিতির শিকার হতে না হয় কিংবা শারীরিকভাবে অসুস্থতার পরিণতি ভোগ করতে না হয় সেদিকে সবাইকে নজর দিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

আমাদের গ্রামগুলো আগের সেই স্নিগ্ধ, নিটোলরূপ হারিয়ে ফেলছে অপরিকল্পিতভাবে ঘরবাড়ি তৈরির কারণে। এ নিয়ে কেউ ভাবছেন না। আমাদের গ্রামগুলোয় ইচ্ছেমতো যেখানে-সেখানে বাড়িঘর তৈরি করছেন অনেক মানুষ। যার যেমন ইচ্ছে হচ্ছে, সেভাবেই ঘরবাড়ি উঠছে। যার ফলে কুৎসিত, কদাকার জনপদে পরিণত হচ্ছে একেকটি গ্রাম। এটি আমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য, পরবর্তী প্রজšে§র জন্য ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গ্রামগুলো ক্রমেই পরিণত হচ্ছে অপরিকল্পিত কুৎসিত শহরে। এখন আমরা ঢাকাকে কদাকার নগরী হিসেবে আখ্যা দিচ্ছি। এখন অবস্থা যেভাবে গড়াচ্ছে তাতে অচিরেই সারাদেশেই কদাকার জনপদে রূপান্তরিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমাদের গ্রামগুলো নানা কারণে নানাভাবে চরিত্র-সংস্কৃতিতে শহরমুখী হয়ে পড়ছে। একইভাবে গ্রামের মানুষও ইদানীং নিজ বাসভূমি ছেড়ে শহরে চলে যাওয়ার জন্য নানা উপায় খুঁজছে। গ্রাম ছেড়ে শহরে অভিবাসনের ক্ষেত্রে একসময়ে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল দারিদ্র্য। প্রচণ্ড অভাব ছিল গ্রামগুলোয়। কৃষকরা তাদের ন্যায্য মূল্য পেতেন না উৎপাদিত কৃষিপণ্যের। আবাদি জমি অনুর্বর থাকত। সেখানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদের তেমন উদ্যোগ ছিল না। যে কারণে গ্রামে অভাব, মঙ্গা, দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকত। তখন কেউ কেউ অভাবের যন্ত্রণা সইতে না পেরে সচ্ছলতা সমৃদ্ধির আশায় শহরে পা রাখত। তখন মানুষ অন্নের অভাবে শহরমুখী হতো কোনোভাবে কাজ করে পেট চালানোর জন্য। গ্রামের সবাই এখন শহরমুখী নানাভাবে। শহরমুখী এই প্রবণতার পেছনে যুক্তিহীন আকর্ষণ রয়েছে শহরের প্রতি। গ্রামের লোকজনদের অনেকেই মনে করেন, শহরে আকাশে-বাতাসে টাকা উড়ে বেড়ায়, গিয়ে তা ধরতে পারলেই হলো। এটা যে কত বড় ভুল ধারণা, তা শহরে পা রাখার পর তারা উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু তখন আর করার কিছু থাকে না। দু’চোখে নানা রঙিন স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে পা রাখা নারী-পুরুষগুলো যখন প্রত্যাশা অনুযায়ী নিজেকে দাঁড় করাতে পারেন না, গ্রামের ভিটেমাটি বিক্রি করে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে বিদেশে চাকরি নিয়ে যেতে পারেন না, তখন শহরে কোনোভাবে মাথা গুঁজে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেন। ভাড়া করা বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। যেখানে অনেক সময় সুস্থভাবে বসবাসের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা থাকে না। ঢাকা চট্টগ্রাম মহানগরীর বস্তিগুলোয় কী নিদারুণ মানবেতর জীবনযাপন করছেন লাখ লাখ নারী-পুরুষ, শিশু। এক ধরনের কুৎসিত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনোভাবে বেঁচে থাকাটা জীবনযাপন নয়। অথচ গ্রামে তাদের চমৎকার সুন্দর ছিমছাম বসতবাড়ি ছিল। সামনে একটি উঠোন। বাড়ির পাশের আঙিনায় সবজি, আনাজপাতির চাষ। সারা বছর টাটকা শাকসবজি পাওয়াটা কোনো সমস্যা নয় সেখানে কিন্তু মিথ্যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে শহর নামক তথাকথিত স্বর্গে এসে দারুণ দুর্বিষহ জীবনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। তারা যদি গ্রামে থেকে বিদ্যমান সামাজিক, অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের, উন্নত জীবনযাপনের চেষ্টা চালিয়ে যান তাহলে অপরিকল্পিত নগরায়ণের অভিশাপ মুক্ত হতে পারব আমরা। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম শহরে বস্তির বিস্তৃতি ঘটছে ক্রমেই। বস্তিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা বাড়ছে। বস্তিগুলোয় কুখ্যাত অপরাধীচক্রের নানা কর্মকাণ্ড চলছে অবাধে। সেখানে মাদক ব্যবসার আখড়া গড়ে উঠছে। মাঝে মধ্যে বস্তি উচ্ছেদের অভিযান চালানো হলেও এর মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

শহরমুখী গ্রামীণ জনস্রোতকে অনুৎসাহিত করতে হলে গ্রামেই তাদের কর্মসংস্থানের নানা আকর্ষণীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বছরজুড়ে যেন কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়, কৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ডের বাইরে ছোট-বড় শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ জোরালো করতে হবে। গার্মেন্টস শিল্প কারখানাগুলো কেবল ঢাকা-চট্টগ্রাম নগরী এবং এর শহরতলিতে সীমাবদ্ধ না রেখে ধীরে ধীরে গ্রাম এলাকায়ও ছড়িয়ে দিতে হবে। গার্মেন্টস শিল্প কারখানা স্থাপনের উপযোগী অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে গ্রামগুলোয়। গ্রামীণ এলাকায় ছোট এবং মাঝারি আয়তনের গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলে অপেক্ষাকৃত স্বল্প মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া সম্ভব হবে। এতে শিল্প উৎপাদন ব্যয় কমবে অনেকাংশে। গ্রামেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলে গ্রামের লোকজনকে আর কাজের জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাতে হবে না।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক