মনিরুল হক রনি: যানজটের ঢাকা শহরে গণপরিবহনে যাতায়াতের দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির বিকল্প হিসেবে জনপিয় হয়ে উঠেছে মোটরসাইকেল। শুধু ঢাকা শহর নয়, দেশের সর্বত্রই মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়িয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুযায়ী, গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত সব ধরনের যানবাহনের মোট সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৪৬ হাজার ৯৮৭টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যাই ৯ লাখ ৩৯ হাজার ৪১৮টি, যা মোট যানবাহনের ৫০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই ঢাকায় নিবন্ধিত হয়েছে ৪৪ হাজার ৪১২টি মোটরসাইকেল। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন নিবন্ধিত হয়েছে ৩৭০টি। অন্যদিকে সারাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫২ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৬টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৬ লাখ ৭৮ হাজার ৫৬১টি, যা মোট যানবাহনের ৭০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অথচ ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ছিল ১৫ লাখের কম। ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবছর তিন লাখের বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হচ্ছে। ক্যানসার সেলের মতো মোটরসাইকেলের এই দ্রুত বৃদ্ধি রাস্তাঘাটে ত্রাসের সৃষ্টি করছে। অদক্ষ ও অল্প দক্ষ মোটরসাইকেল চালকদের বেপরোয়া গতি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পথচারীদের জন্য। বিশেষ করে উঠতি বয়সের কিশোর-তরুণরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে উচ্চ শব্দে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক। এতে পথচারীসহ ছোট ছোট যানবাহনকে এক ধরনের অজানা আতঙ্কে নিয়ে পথ চলতে হচ্ছে। এসব বেপরোয়া চালকদের তীব্র গতি আর কারণে-অকারণে বাজানো উচ্চ শব্দের হর্ন তৈরি করছে মারাত্মক শব্দদূষণ; মানুষের স্বাভাবিক চলাচলকে করছে দুর্বিষহ। ২০১৭ সালে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক দেশের আট বিভাগীয় শহরের শব্দদূষণের ওপর করা এক জরিপ বলছে, আটটি শহরেই ৮০ শতাংশ শব্দদূষণ করে যানবাহনের হর্ন। আর এই ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের জন্যই দায়ী ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের হর্ন।
মোটরসাইকেলের দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যাও। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণা বলছে, প্রতিবছর দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন ২৮ জনের মতো, যা গবেষণায় আসা ১৬টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। ওই ১৬টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন ভিয়েতনামের মানুষ। সেখানে প্রতি এক হাজার মানুষের বিপরীতে মোটরসাইকেল আছে ৩৫৮টি, যেখানে বাংলাদেশে আছে মাত্র সাতটি। অথচ দুর্ঘটনার দিক দিয়ে সর্বোচ্চ বাংলাদেশ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে দুই হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে দুই হাজার ২১৪ জনের, যা ওই বছর সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৯ শতাংশ এবং সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ। আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮৩০ জন। বছরের দুই ঈদে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যায় আরও বহুগুণে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাও। যেটির ব্যত্যয় ঘটেনি এবারের ঈদুল আজহায়ও। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য এবারের ঈদে ঢাকা থেকে মোটরসাইকেল ভ্রমণে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হলেও প্রত্যাশানুযায়ী কমেনি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, এবারের ঈদুল আজহার আগে ও পরে ১৫ দিনে সড়ক-মহাসড়কে ৩১৯টি দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৯৮ জন ও ৭৭৪ জন। হতাহতের এ সংখ্যা ছিল বিগত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর গত বছরের তুলনায় এবার ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ২৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ৩১ দশমিক ৪১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও মৃত্যু হয়েছে মোটরসাইকেলে। সংগঠনটির তথ্য বলছে, এবারের ঈদে ১১৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৩১ জন এবং আহত হয়েছে ৬৮ জন, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং নিহত হওয়ার ক্ষেত্রে ৩২ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ঈদের আগে ও পরে ১২ দিনে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ২৭২টি। এতে নিহত হয়েছে ৩১১ জন এবং আহতের সংখ্যা এক হাজার ১৯৭ জন। এ সময়ের মধ্যে ১৫৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১২৩, যা মোট নিহতের ৩৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত চালক ও আরোহীদের অধিকাংশই ছিল তরুণ বয়সের, যাদের বয়স ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে এর সহজলভ্যতা, মানসম্মত গণপরিবহন ব্যবস্থার অভাব ও সরকারের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকাকে অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা। আবার মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে নিয়ম না মানা, চালক ও আরোহীদের হেলমেট পরতে অনীহা, মোটরসাইকেলে দুজনের অধিক ওঠা, চালকদের বিরতিহীনভাবে একটানা চালানো, ফাঁকা সড়কে বেপরোয়া গতি প্রভৃতিও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়া জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন ও সড়ক বাতি না থাকা, মহাসড়কের নির্মাণত্রুটি, উল্টো পথে যানবাহন চালানো, ইজিবাইক ও অটোরিকশার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়াও সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে উল্লিখিত সংগঠন দুটির তথ্য উঠে এসেছে।
মোটরসাইকেলের সংখ্যা ও অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা বৃদ্ধি আমাদের জনজীবনের জন্য অভিশাপস্বরূপ। এর লাগাম টেনে ধরা জরুরি। এজন্য মোটরসাইকেল ক্রয়-বিক্রয়, নিবন্ধন ও চালকের লাইসেন্স প্রাপ্তিতে প্রচলিত নীতিমালার আধুনিকায়ন প্রয়োজন। মোটরসাইকেল নিবন্ধন ফি, করের হার ও পার্টসের দাম বাড়িয়ে দিয়েও মোটরসাইকেলের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে আরোপ করতে হবে আরও কঠোরতা। প্রয়োজনে লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বয়সের সীমা বাড়ানোসহ একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত আরোপ করার বিষয়টি ভেবে দেখা যায়। স্কুল-কলেজপড়–য়া উঠতি বয়সের ছেলেরা যাতে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে, সেজন্য অভিভাবকদের যেমন সচেতন থাকা জরুরি, তেমনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেও তাদের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সঠিকভাবে হেলমেট পরিধান করলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমে। আর গুরুতর আঘাতের ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ। তাই রাজধানীর মতো গ্রামাঞ্চলে ও ছোট শহরগুলোতে হেলমেট পরিধানের ক্ষেত্রে কড়া তদারকি করতে হবে। উচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া গতির চালকদের লাইসেন্স বাতিলসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নতকরণ, সড়কে লেন ব্যবস্থা চালুকরণ, ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, বেহাল সড়ক-মহাসড়ক সংস্কার প্রভৃতিতে সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো যখন গণপরিবহনকেন্দ্রিক উন্নয়নের দিকে এগোচ্ছে, আমরা তখন এগোচ্ছি মোটরসাইকেলকেন্দ্রিক উন্নয়নে। এটা আমাদের চরম ব্যর্থতা। তাই দুর্ঘটনা কমানো, যানজট নিরসন এবং শব্দদূষণের মতো মারাত্মক সমস্যা দূর করার জন্য মোটরসাইকেলের উল্লম্ফন কমাতেই হবে, নতুবা অচিরেই মোটরসাইকেলের অতি অত্যাচারে আরও অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন। মৃত্যু কার কোথায়, কীভাবে হবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না ঠিকই; কিন্তু কোনো মৃত্যুই যাতে সড়কের অরাজকতা ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ
সাভার সরকারি কলেজ, ঢাকা