রহমত রহমান: কাস্টম হাউসে বহিরাগত হিসেবে জীবন শুরু। ঘুষ দিয়ে চাকরি নিলেন মাস্টার রুলে। মাস্টার রোলে চাকরিতে যেন হাতে পেলেন আলাদিনের চেরাগ। এই চেরাগ ঘষলেই বের হয়ে আসে টাকা। সেই চেরাগ হলেন ব্যবসায়ীরা। যাদের ঘসে বা জিম্মি করে টাকা কামাতেন। দুর্নীতিতে কামানো সেই টাকা আবার ঘুষ হিসেবে দিয়ে মাস্টার রোলের চাকরি করলেন স্থায়ী। চাকরি স্থায়ী হলো মাত্র চার বছর। এই চার বছরেই কয়েকটি ব্যাংকে কিনলেন কোটি টাকার এফডিআর ও লাখ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। মোটা অঙ্কের টাকায় শহরে কিনলেন জমি। মাসে ব্যবহার করেন লাখ টাকার পারফিউম। প্রতি মাসে পরিবর্তন করেন আইফোন। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মো. রায়হান উদ্দিন নামে এক অফিস সহায়কের বিরুদ্ধে দুর্নীতির টাকায় আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার এমন অভিযোগ উঠেছে। মূলত ব্যবসায়ীদের হয়রানি আর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজম্যান’ হিসেবে কাজ করেই তিনি এই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর সম্পদের মালিক হয়েছেন। সম্প্রতি এই নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) অভিযোগ জমা পড়েছে। অনুসন্ধানেও এর সত্যতা মিলেছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এখানে চাকরি মানেই হাতে আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতো। ঘষা দিলেই দৈত্য নয়, যেন টাকা আর টাকা বের হয়। মাত্র চার বছর আগেও যে ব্যক্তি নিজে চলতে কষ্ট হতো। কাস্টম হাউসে চাকরি হওয়ার চার বছরের মাথায় সে কয়েক কোটি টাকার মালিক। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অফিস সহায়ক মো. রায়হান উদ্দিনের চাকরি নেন ২০১৯ সালে। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বহিরাগত হিসেবে ছিলেন। বহিরাগত হলেও ব্যবসায়ীদের কাছে পরিচয় দিতেন তিনি কাস্টম হাউসের কর্মচারী। চতুর রায়হানের বড় গুণ হলো হাউসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করা। অর্থাৎ রাজস্ব ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের খুঁজে বের করতেন রায়হান। টাকার বিনিময়ে রাজস্ব ফাঁকিতে সহায়তার জন্য চুক্তি করতেন তিনি। পরে চুক্তি অনুযায়ী টাকা নিয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের একটা অংশ দিতেন। বাকি অংশ তিনি মেরে দিতেন।
আরও জানা গেছে, বহিরাগতদের চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ‘ফালতু’ বলা হতো। ফালতু থেকে রায়হান পরে কাস্টম হাউসে মাস্টার রোলে চাকরি নেন। চাকরি হওয়ার পর থেকে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। রায়হান অসাধু ব্যবসায়ী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নিয়ে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। কোন ফাইলে কীভাবে কত টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়া যায়, কীভাবে কাদের ম্যানেজ করতে হয়-তা দ্রুত রপ্ত করে ফেলেন। এতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন রায়হান। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ফাইল আটকে রাখতেন। আর সেই কর্মকর্তাদের হয়ে ঘুষ নিতে রায়হান। ঘুষের সেই টাকা থেকে রায়হান ভাগ পেতেন। টাকা না দিলেই করতেন হয়রানি। মাস্টার রোলের একজন কর্মচারী হলেও ঘুষের টাকায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠেন রায়হান। ২০১৯ সালে মাস্টার রোল থেকে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি নেন তিনি। এই চাকরি নিতে রায়হান হাউসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, চাকরি হওয়ার পর রায়হান আরও ঘুষ নিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কাস্টম হাউসের যেসব শাখায় বেশি ঘুষ লেনদেন হয়, টাকা কমানোর মেশিন রয়েছে, সেখানে পোস্টিং নিতেন রায়হান। আর সেই পোস্টিং নিতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হতো রায়হানকে। পোস্টিং নিয়েই ঘুষ নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠতেন তিনি। কর্মকর্তা ফাইল ছেড়ে দিলেও ঘুষ দিতে হতো তাকে। দুর্নীতির দায়ে রায়হানকে কয়েকবার শাস্তি দেয়া হলেও তিনি শোধরাতেন না। অসাধু ব্যবসায়ী আর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কাছে খুবই জনপ্রিয় রায়হান। কারণ রায়হানকে টাকা দিয়ে হাউসের যেকোনো কাজ করানো যায়। আর দুর্নীতির আখড়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে রায়হানের টাকার অভাব হয় না। তাই তো চাকরি হওয়ার মাত্র চার বছর পর এখন তিনি কয়েক কোটি টাকার মালিক। কয়েকটি ব্যাংকে রয়েছে কোটি টাকার এফডিআর।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রায়হানের ইসলামী ব্যাংকে আলাদা ১৫ লাখ ও ১৬ লাখ টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে আলাদা দুই লাখ করে চার লাখ টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে আলাদা দুই লাখ, চার লাখ, পাঁচ লাখ টাকা ও ১০ লাখ টাকা, এক্সিম ব্যাংকে আলাদা পাঁচ লাখ, সাত লাখ ও ১৮ লাখ টাকার এফডিআর রয়েছে। এই চারটি ব্যাংকে তিন, পাঁচ, পাঁচ, সাত লাখ টাকা করে মোট ২০ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট রয়েছে। চতুর রায়হান এসব এফডিআর ও ডিপোজিট নিজের নামে না করে পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে করেছেন। এছাড়া পাঁচটি ব্যাংকে অর্ধকোটি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছেন। সেটাও নিজের নামে নয়, পরিবারের সদস্যের নামে কিনেছেন তিনি। দুর্নীতির টাকায় রায়হান চট্টগ্রাম শহরে ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রায় কোটি টাকায় দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম শহরে পৌনে এক কোটি টাকা দিয়ে জায়গা কিনেছেন। রায়হানের পৈতৃক তার বাড়ি চট্টগ্রামের বন্দর থানা এলাকায়। সেখানে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি বানিয়েছেন। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় থেকে মাত্র চার বছরে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন রায়হান উদ্দিন।
অপরদিকে, অভিযোগে বলা হয়েছে, কাস্টম হাউসে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, অসাধু ব্যবসায়ী আর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কাছে রায়হান ‘ম্যানেজ ম্যান বা ম্যানেজ ভাই’ নামে পরিচিত। কারণ কাস্টম হাউসে রাজস্ব ফাঁকিতে সহায়তা, অবৈধ পণ্য বা পণ্য ভর্তি কনটেইনার খালাস, রাজস্ব ফাঁকি ও গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েবসহ হাউসের যেকোনো অনৈতিক কাজ টাকার বিনিময়ে রায়হানকে দিয়ে করানো যায়। আর টাকা না দিলে হয়রানি করেন রায়হান ও তার সহযোগীরা। গত কয়েক বছরে বন্দর থেকে মদ ও সিগারেটের যেসব কনটেইনার বের হয়েছে, সেই চক্রের সঙ্গে রায়হানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে হাউসের কম বেশি সবাই জানে। কিন্তু অজানা কারণে তাকে জড়ানো হয় না। সম্প্রতি কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা একজন ব্যবসায়ীর ফাইল সই করে দিয়ে দেয়। কিন্তু রায়হান সেই ব্যবসায়ীকে জানায়, টাকা ছাড়া কর্মকর্তা ফাইল সই করবেন না। ওই কর্মকর্তার জন্য ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে বলেন। পরে ওই ব্যবসায়ী কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কমিশনার খোঁজ নিয়ে দেখেন কর্মকর্তা অনেক আগেই ফাইল ছেড়ে দিয়েছেন। কর্মকর্তার নাম করে রায়হান ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। এই অভিযোগে রায়হানকে শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু অদৃশ্য বলে রায়হান পার পেয়ে গেছেন।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে রায়হানের একাধিক সহকর্মী জানিয়েছেন, দুর্নীতির টাকায় রায়হান বিলাসী জীবনযাপন করেন। লাখ টাকার দামি পারফিউম আর পোশাক ব্যবহার করেন তিনি। ঘুষের টাকায় কেনা আইফোন ব্যবহার করেন। প্রতি মাসে আইফোন পরিবর্তন করেন তিনি। ২০তম গ্রেডের একজন অফিস সহায়কের বেতন সাকল্যে ১৪-১৫ হাজার টাকা। কিন্তু রায়হানের মাসিক খরচ লাখ টাকার বেশি। হাউসে রায়হানের মতো আরও কয়েকজন অফিস সহায়ক, কম্পিউটার অপারেটর, কয়েকজন সিপাহি দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। কেবল ব্যবসায়ীদের হয়রানির মাধ্যমে এই টাকা আয় করেছেন।
দুর্নীতি আর ব্যবসায়ীদের হয়রানির বিষয়টি অস্বীকার করেন রায়হান উদ্দিন। দুর্নীতির টাকায় ব্যাংকে এফডিআর, সঞ্চয়পত্র, জায়গা কেনা, বাড়ি করার অভিযোগ বিষয়ে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এসব তো ভুল তথ্য। দরকার হলে আমি আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলব। এগুলো কমপ্লিট ভুল তথ্য।’ তিনি বলেন, ‘আমার যখন চাকরি ছিল না, তখন বাবার বিজনেস করতাম। বাবার নিজের সম্পত্তি আছে। আমার বাবা বন্দর ট্রাক মালিক সমিতিতে চাকরি করতের। দুই, তিন, চার, পাঁচ লাখ টাকা এফডিআর করা ছিল।’ অসাধু ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে আপনি কাজ করেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে রায়হান বলেন, ‘না না। প্রয়োজনে আপনি আমার বিষয়ে খোঁজ নিতে পারেন আমি কীভাবে কাজ কর। আমি খুব স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করি। নিউজ না করলে হয় না?’
রায়হানের দুর্নীতির বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, দুর্নীতির বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখা হয়। অনিয়মের অভিযোগ পেলে সেই কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে হাউস থেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে হয়রানির বিষয়ে আমরা সব সময় সতর্ক।