প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

অবয়বে নয়, মানসিকতায় মানুষ হই

মানুষ সৃষ্টির সেরা। বাহ্যিক গঠনে মানুষ হিসেবে জš§ নিলেও আমৃত্যু মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে তাকে অবিরত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। মানুষকে প্রকৃত অর্থেই মানুষ করে তোলে সুশিক্ষা। শিক্ষার হার ক্রমবর্ধমান, কিন্তু মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি কি বাড়ছে? না, এর কারণ সুশিক্ষার অভাব। সুশিক্ষা সম্পূর্ণভাবেই আচরণগত ও মানসিক ব্যাপার, যা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত।

অতৃপ্তি মানুষের স্বভাবজাত। এই অতৃপ্তিতে পূর্ণতা দিতে আমরা বেছে নিচ্ছি সংক্ষিপ্ত বা বাঁকা কোনো পথ। নৈতিক অবক্ষয় বন্যার মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজটাকে। ঘুষ কেলেঙ্কারির দায়ে কোনো সংসদ সদস্যের বিদেশের জেলখানায় থাকা, জাতীয় পাঠ্যপুস্তক রচনায় চুরির অভিযোগ এবং বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াও যে সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ ওঠে, সে সমাজে নৈতিকতা কতটা ভঙ্গুর তা বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়। মানুষ কখনও অপরাধী হয়ে জš§ নেয় না। প্রকৃত শিক্ষার অভাব তাকে অপরাধী করে তোলে। আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষই ধর্মপ্রাণ। নিয়মিত সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তারপরও খুন, ধর্ষণ ও ঘুষ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এর মূল কারণ আমরা ধর্মকে হƒদয় দিয়ে অনুধাবন না করে দৈনন্দিন আচারের একটা অংশ বানিয়ে রেখেছি। বিশাল পৃথিবীটা আমাদের কাছে ছোট হয়ে ধরা দিয়েছে, দূর-দূরান্তের নতুন নতুন সম্পর্কগুলোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই পারিবারিক সম্পর্কগুলো আলগা করে দিচ্ছি। এক ঘরের বাসিন্দা হয়েও একজন আরেকজনের কাছের মানুষ নই। সব সামাজিকতা যেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সমাধান ছবি তুলে, লাইভে গিয়ে, কিংবা নিজের গ্যালারি ঘেঁটে সবচেয়ে সুন্দর ছবিখানা আপলোড দিয়ে হ্যাশট্যাগ দিচ্ছিÑ‘নো রেসিজম’। একটি ঘটনার রেশ শেষ হতে না হতেই নতুন ঘটনা, প্রত্যেকটি নতুন ঘটনার বীভৎসতা তার আগেরটার চেয়েও বেশি।

প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে, কিন্তু প্রশংসা শুনতে চাওয়ার এ কী হিংস্র চাহিদা চারদিকে! একবার ভাবুন তো, কটা ভালো কাজ আছে, যা করার পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেননি বা গোপন রেখেছেন। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সম্পূর্ণ বোধহীন হয়ে যাচ্ছি। গলাটিপে হত্যা করছি আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মনুষ্যত্ববোধকে। চারদিকে শুধু চাই চাইÑবাড়ি চাই, টাকা চাই, পদবি চাই; এই অনিঃশেষ চাওয়াগুলো পূরণ করতে কাউকে টেনেহিঁচড়ে ধুলোয় মিশিয়ে দিতেও আমাদের আপত্তি নেই। ভালো-মন্দ বাছ-বিচার করার সময় আমাদের নেই। আর এভাবেই আমাদের ভেতরের সুপ্ত মনুষত্ববোধ সুপ্ততর হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যায়। ভালো মানুষ সব ক্ষেত্রেই পরাজিত ও কোণঠাসা। মানবীয় এই সমাজে যেন পাশবিকতার উল্লাস। কাউকে বুলি করতে আমাদের বিবেকে এতটুকু বাধে না, বিরামহীন মিথ্যা বলে যেতে পারি অবলীলায়, ঘুষ খাওয়া যেন একটা কালচার। আমরা আজ বড়ই মডার্ন, বড়ই সভ্য। আসুন মডার্ন সফল মানুষের এই মেকি মুখোশ থেকে বেরিয়ে একজন মানুষ হইÑযে মানুষ সত্যিই মানুষ, যে মানুষ কোনো অন্যায় করতে পরে না, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না, যার মিথ্যা বলতে বিবেকে বাধে, যে ঘুষ কি তা জানে না, যে জানে না অন্যের হক নষ্ট করতে, যে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে এতটুকু কার্পণ্য করে না, যে মানুষ ‘এই পৃথিবীটা আমার’ বলে প্রকৃতিকে শোষণ করবে না, যে এই পৃথিবীর জন্য মিশে যাবে প্রকৃতির সরলতায়। আমরা সেরা হতে চাই, আত্মনির্ভরশীল হতে চাইÑতবে আত্মকেন্দ্রিক নয়।

ফাতেমা তুজ জোহরা

শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়