নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। সে চাহিদা পূরণে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গুরুত্বারোপ করছে সরকার। প্রয়োজন অনুসারে কারখানাগুলোর সংস্কার কার্যক্রম চলছে। এজন্য বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল শনিবার এসব কথা বলেছেন।
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে দ্বিতীয় ঢাকা অ্যাপারেল সামিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, পোশাক খাতের সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা সহায়তা করতে পারেন। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বিজিএমইএ-কে দেওয়া হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করার বিষয়টি পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বিশ্ববাজারে আমাদের পণ্যসামগ্রীর চাহিদা কীভাবে বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে আমাদের কাজ করতে হবে। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী মুজিবুল হক এবং বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়েদুন। বিজিএমইএ’র সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। এছাড়া সংগঠনটির সিনিয়র সহ-সভাপতি মাইনুদ্দিন আহমেদ এতে ধন্যবাদ জানান। এ সময় মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূত, কূটনৈতিক মিশনের সদস্য, উন্নয়ন সহযোগী ও তৈরি পোশাক খাতের দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজিএমইএ, সরকার, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগীÑসবাই মিলে একটি নিরাপদ ও টেকসই শিল্প গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাচ্ছি।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী পুরোনো বাজারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করে রফতানি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের রফতানি মূলত উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরশীল। এটা রফতানির জন্য ভালো নয়।
পোশাকশিল্পের বিকাশে সরকারের কিছু উদ্যোগ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজিএমইএ-কে তাদের দাবি অনুসারে সিও ইস্যু করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষায়িত বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পোশাকশিল্প সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ শিল্পে অগ্রিম আয়কর এক দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক সাত শূন্য শতাংশ করা ও করপোরেট করের হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও শ্রমিকদের কল্যাণে গৃহীত কর্মসূচির কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
উদ্বোধনী সেশনের পর অ্যাপারেল সামিটের তিনটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। প্রথম সেশনে বাংলাদেশের ব্যবসানীতি ও পরিবেশ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, কানাডার গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান নির্বাহী রবার্ট মেকডুগাল, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা, শীর্ষ ব্র্যান্ড মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের বাংলাদেশের প্রধান স্বপ্ন ভৌমিক, বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ক্রিস্টোফার উড্রোফ, ইউসিবির চেয়ারম্যান এমএ সবুর, বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির, এমসিসিআই’র সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এফবিসিসিআই’র প্রথম সহ-সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দীন এ সেশন পরিচালনা করেন। সেশনে পোশাক খাতের উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ ও বন্দর সেবার উন্নয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, বলা হচ্ছে ভারত বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাবে। এটার সঙ্গে আমি দ্বিমত করি না। কারণ ভারত পোশাক খাতে ভর্তুকি বাড়িয়েছে। তারা আগামী বছরে ৪০ বিলিয়ন রফতানি করবে। কিন্তু বাংলাদেশের অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, ক্রেতারা এখানে এখনও নিরাপত্তা ঝুঁকি দেখছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। সম্প্রতি আশুলিয়ায় শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের জেলে ঢোকানো হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বেতন বাড়ানোর দাবি করেছিল। এটা বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট করেছে। আশুলিয়ার ঘটনার ফল হিসেবে ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফেরাতে বাধ্য হতে পারেন।
জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমি আশ্চর্য হই যে শুধু বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন নিয়েই কথা হয়। চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়ার ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে কোনো কথা হয় না। অথচ চীনে প্রতিদিন দুর্ঘটনা হয়। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, অস্ত্রবাদে সবকিছু নীতির আওতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের ডিউটিমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তো দেয়নি। আমরা সামান্য একটু জিএসপি সুবিধা পেতাম যুক্তরাষ্ট্রে প্লাস্টিক, সিরামিকস ও তামাকে। তাও স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। আফ্রিকার দেশ কেনিয়া মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলার রফতানি করে। তারাও যুক্তরাষ্ট্রে কোটা পায়। অথচ আমরা পাই না। কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার জন্য আমাদের মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। অথচ একটা পয়সাও দাম বাড়ানো হয়নি। এগুলো নিয়ে কেউ কথা বলেন না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ হচ্ছে বীরের দেশ। আমরা সবকিছুই মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো।
এছাড়া আরও দুটি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। ‘কোলাবোরেটিভ অ্যান্ড রেসপনসিবল সোর্সিং ফর সাসটেইন্যাবল গ্রোথ’ শীর্ষক সেশনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি ফারুক হাসান, ড্যান্সক ফ্যাশন অ্যান্ড টেক্সটাইলের সিইও থমাস ক্লোসেন, শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার প্রমুখ অংশ নেন। শেষ সেশনে বাণিজ্যসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনের সভাপতিত্বে বাংলাদেশের অ্যাপারেল খাতের ভবিষ্যৎ সংস্কার ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। এতে অংশ নেন সুইডিশ রাষ্ট্রদূত ইয়োহান ফ্রিসেল, বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম, সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, নিউএজ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম, আইএলও’র বাংলাদেশ প্রধান শ্রিনিবাস রেড্ডি প্রমুখ।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো অ্যাপারেল সামিটের আয়োজন করে বিজিএমইএ। তাজরীন অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধসের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত নিয়ে সৃষ্টি হওয়া নেতিবাচক ভাবমূর্তি কাটিয়ে উঠে গার্মেন্ট খাতকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থিতিশীল হিসেবে তুলে ধরতে এ সামিট অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল দ্বিতীয় সামিটের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সমৃদ্ধির পথে একসঙ্গে’।