রোহান রাজিব: বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ করেছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া সীমা অতিক্রম করায় ব্যাংক দুটির আমানতকারীদের আমানত ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা। আমানত ও ঋণের ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যপূর্ণ শৃঙ্খলা থাকা দরকার তা ধরে রাখা জরুরি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৯ সালের এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রচলিত ধারার ব্যাংক ১০০ টাকার আমানতের বিপরীতে ৮৫ এবং ইসলামি ধারার ব্যাংক ৯০ টাকা ঋণ দিতে পারে। একে ব্যাংকিং পরিভাষায় অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) বা ঋণ-আমানত অনুপাত সীমা বলা হয়।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের জানুয়ারির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমানত ও ঋণের মধ্যে যে ভারসাম্য থাকা দরকার তা ভেঙে ঋণ দিয়েছে এ দুটি ব্যাংক। জানুয়ারিতে প্রচলিত ধারার ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯৮ দশমিক ২৩ শতাংশে। ব্যাংকটি ৪০ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে ৪১ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। তাদের ইডিএফের ঋণ এক হাজার ১৪৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকটি গত ডিসেম্বরেও ঋণ সীমা অতিক্রম করেছিল। ওই সময় এডিআর দাঁড়িয়েছিল ৯৫ দশমিক ৬৬ শতাংশে। ডিসেম্বর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকে ৪১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকার বিপরীতে ৪২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা ঋণ ছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মেহমুদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, গত বছর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাংক খাতে নিয়ে নেতিবাচক খবর প্রচার হয়েছে। এর প্রভাবে আমাদের ব্যাংক থেকে প্রচুর আমানত চলে গেছে। যদিও এখন সে প্রভাব কমে গেছে। তবে ওই সময়ের চলে যাওয়া আমানত কাভার করতে সময় নিচ্ছে। এ জন্যই এডিআর মেনটেইন করতে পারছি না।
নানা অনিয়মের কারণে ২০১৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও ব্যাংকটির অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। সম্প্রতি এমডি পদত্যাগের পর আবার আলোচনায় আসে ন্যাশনাল ব্যাংক। এবার আরও নড়েচড়ে বসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেনামি ঋণ ও ঋণ বিতরণে অনিয়ম ঠেকাতে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের ১০ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নগদ আদায় ছাড়া পুরোনো ঋণ নবায়ন করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া শতভাগ নগদ টাকা জমা ছাড়া কোনো ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এখন ব্যাংকটির ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ ঋণই খেলাপি।
অপরদিকে শরিয়াভিত্তিক গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম লঙ্ঘন করে সীমার অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করেছে। ফলে তাদের এডিআর দাঁড়িয়েছে ১০২ দশমিক ২৭ শতাংশে। জানুয়ারি শেষে ব্যাংকটি ১১ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে ১১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা।
ব্যাংকটি ডিসেম্বরেও ঋণ সীমা অতিক্রম করে। ওই সময়ে ১১ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার বিপরীতে ১১ হাজার ৮৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। ফলে ডিসেম্বরে তাদের এডিআর দাঁড়ায় ৯৯ দশমিক ৯৭ শতাংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৫৬ কোটি টাকায়। এখন ব্যাংকটির ২ দশমিক ১৬ শতাংশ ঋণই খেলাপি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ হাবিব হাসনাতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, এডিআর সীমা অতিক্রম করলে ব্যাংকের রেগুলেশনের কমপ্লায়েন্স ভঙ্গ হয়। যার জন্য অনেক সময় জরিমানা দিতে হয়। এসব ব্যাংকের ক্ষেত্রে জরিমানার চিত্র দেখা যায় না। কারণ এরা ক্ষমতার প্রভাবের কারণে ছাড় পেয়ে যায়। তবে ভালো ব্যাংক ভঙ্গ করলে সঙ্গে সঙ্গে জরিমানা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো নিয়মিত এডিআর সীমা অতিক্রম করতে থাকলে আমানতকারীদের আমানত ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও কঠোর হওয়া উচিত। সবার ক্ষেত্রে একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যেহেতু ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী লাইসেন্স প্রাপ্ত, তাই ব্যবসা করতে হলে নিয়ম মেনেই করতে হবে। নিয়ম লঙ্ঘন করলে ব্যবস্থা নিতে হবে।