প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে তিনগুণ দাম দিতে হবে!

ইসমাইল আলী: ভারতের আদানি গ্রুপের গড্ডা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। এজন্য চুক্তি হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। আগামী ডিসেম্বর থেকে আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর কথা রয়েছে। তবে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাংলাদেশের অন্যান্য কেন্দ্রের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। এমনকি কয়লার মূল্যও ধরা হয়েছে দেশের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেশি। এতে আদানির বিদ্যুৎ কেনায় খরচ পড়বে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়ের প্রায় তিনগুণ।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে গত অর্থবছর ও চলতি অর্থবছরের জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও খাতভিত্তিক ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যয়েরও বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত অর্থবছর ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি ছিল। এতে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় ৭৬৪ কোটি ৪০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি বাবদ বিল গুনতে হয় দুই হাজার ১৬৪ কোটি টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় দুই হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় হয় চার হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬ টাকা ১১ পয়সা।

চলতি অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হয়েছে (আদানি ছাড়া) ৮২৪ কোটি ৬০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি বাবদ বিল গুনতে হবে দুই হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ দুই হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে ভারত থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ আমদানিতে (আদানি ছাড়া) ব্যয় পড়বে ছয় টাকা ৪১ পয়সা।

এদিকে চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর থেকে আদানির বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ৭২৫ মেগাওয়াট। এতে আমদানির সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হয়েছে ২৯৮ কোটি ৭০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি বাবদ বিল গুনতে হবে চার হাজার ৭৯ কোটি টাকা আর ক্যাপাসিটি চার্জ এক হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ আদানির বিদ্যুৎ কিনতে মোট ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি ইউনিটের দাম পড়বে ১৭ টাকা ৮৭ পয়সা।

তথ্যমতে, ভারতের আদানির কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে বাংলাদেশ সরকারকে ২৫ বছরে গুনতে হবে এক লাখ আট হাজার ৩৬১ কোটি টাকা (১১.০১ বিলিয়ন ডলার)। এ অর্থ দিয়ে কমপক্ষে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। ওই ক্যাপাসিটি চার্জ কর্ণফুলী টানেলের মোট বাজেটের ৯ গুণ অথবা ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের চারগুণেরও বেশি। ‘আদানি গড্ডা কোল পাওয়ার প্লান্ট: অ্যান অ্যাকিলিস হিল অব দ্য পাওয়ার সেক্টর অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

গত জুনে প্রতিবেদনটি যৌথভাবে প্রকাশ করে বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনাবিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) ও ভারতীয় গ্রোথওয়াচ। প্রতিবেদনে বলা হয়, আদানি গ্রুপ প্রতি বছর কমপক্ষে তিন হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা (৪২.৩৩ কোটি ডলার) ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে নিয়ে যাবে। আর আদানির গড্ডা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের দাম প্রতি বছর কমপক্ষে পাঁচ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে বাড়বে। এতে ২০৪৭ সালে আদানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বেড়ে দাঁড়াবে ৩৬ টাকা ৪১ পয়সা।

এদিকে পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনা হচ্ছে প্রতি টন ২৩৭ ডলারে। তবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনায় দাম পড়বে প্রতি টনে ৪৩৪ ডলার। মূলত কয়লার দামে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা না করায় বেশি বিল দিতে হবে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য মাসে ৬০০ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার আশঙ্কা করছে পিডিবি। আর বছরে গচ্চা যাবে প্রায় সাত হাজার ২০০ কোটি টাকা।

আদানির বিদ্যুৎ কেনার বিরোধিতা করে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় উদ্বৃত্ত রয়েছে। চাহিদা না থাকায় নিজস্ব বেশকিছু কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। তার ওপর চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি ও জ্বালানি (গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল) সরবরাহ করতে না পারায় বেশকিছু বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এতে গত তিন মাসে ব্যাপক লোডশেডিং দিতে হয়েছে। এ অবস্থায় অস্বাভাবিক দামে আদানির বিদ্যুৎ আমদানির কোনো মানেই হয় না। এটা সরাসরি বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। তাই এ প্রক্রিয়া থেকে কীভাবে বের হওয়া যায় সে চেষ্টা করা উচিত।

যদিও আদানির বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি বাতিলের কোনো সুযোগ এ মুহূর্তে নেই বলে মনে করেন বিদ্যুৎ খাতের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসেইন। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানির সঙ্গে আন্তর্জাতিক চুক্তি করা হয়েছে। তাই চাইলেও এটি বাতিল বা সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই।

প্রসঙ্গত, আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ-বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আদানির এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করা হয়েছিল। চলতি অর্থবছর তারা চুক্তির অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করবে। তবে পুরোটা সরবরাহ শুরু হবে আগামী অর্থবছর। অন্যদিকে ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এনটিপিসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এনভিভিএন (এনটিপিসি বিদ্যুৎ ভ্যাপার নিগম লিমিটেড) থেকে দুই ফেজে যথাক্রমে ২৫০ ও ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালে চুক্তি করে পিডিবি। প্রথম চুক্তির মেয়াদ ২৫ বছর ও দ্বিতীয়টির ১৫ বছর।

এর বাইরে সেম্বকর্প ইন্ডিয়া থেকে ২৫০ মেগাওয়াট ও পিটিসি থেকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয় ২০১৮ সালেই। এ দুই চুক্তির মেয়াদও ১৫ বছর। আর ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয়েছিল ২০১৬ সালে। পাঁচ বছর মেয়াদি এ চুক্তি শেষ হয় গত বছর। তবে চুক্তির মেয়াদ আরও পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়েছে।