প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হবে সবচেয়ে বেশি

কয়লাভিত্তিক পাঁচ বিদ্যুৎকেন্দ্র

রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে ক্রমেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ। বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে উৎপাদনে আসছে আরও তিনটি কেন্দ্র। সম্প্রতি এক বৈঠকে এ পাঁচটি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়, যা শেয়ার বিজের হাতে এসে পড়েছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে প্রথম পর্ব

ইসমাইল আলী: কুইক রেন্টাল থেকে বেরিয়ে আসতে কয়েক বছর আগে বেশকিছু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয় সরকার। এর মধ্যে ২১টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে ১৩টির লাইসেন্স বাতিল করা হয়। বাকিগুলোর মধ্যে দুটি এরই মধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে এবং আরও তিনটি উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। কয়লাভিত্তিক এ পাঁচটি কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ হাজার ৫০৫ মেগাওয়াট। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল আদানির বিদ্যুৎ।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে আদানির প্রতিনিধির সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ করে পাঁচ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয়ের হিসাব দেখানো হয়। এক্ষেত্রে প্রতি কেন্দ্রের সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার (৮৫ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর) ধরে ব্যয় হিসাব করা হয়েছে। তবে কোনো কেন্দ্রে সক্ষমতার চেয়ে কম হারে উৎপাদন করা হলে গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে।

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন :

পিডিবির তথ্যমতে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট। পূর্ণ সক্ষমতায় এ কেন্দ্রটিতে উৎপাদন করা হলে মাসে প্রায় ৭৭ কোটি ১৯ লাখ দুই হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় হবে ইউনিটপ্রতি ১২ দশমিক ৯৯ সেন্ট। আর জ্বালানি-বহির্ভূত ব্যয় (ক্যাপাসিটি চার্জ) পড়বে চার দশমিক ২১ সেন্ট। অর্থাৎ গড় উৎপাদন ব্যয় পড়বে ১৭ দশমিক ২০ সেন্ট। দেশীয় মুদ্রায় এ ব্যয় পড়বে ১৮ টাকা ৪০ পয়সা (এক ডলার=১০৬.৯৫ টাকা ধরে)।

পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। এর প্রথম ইউনিট উৎপাদনে শুরু করে ২০২০ সালের ১৫ মে। ওই বছর ৮ ডিসেম্বর উৎপাদনে আসে দ্বিতীয় ইউনিটটি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যৌথ মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন লিমিটেড (সিএমসি)। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে দুই কোম্পানি সমান ১০ শতাংশ হারে মোট ২০ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। বাকিটা চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে।

এদিকে চলতি বছর উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের। ২০১৮ সালের এপ্রিলে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে চুক্তি সই হয়। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে চীনের ‘পাওয়ার চায়না রিসোর্স লিমিটেড’ ও বাংলাদেশের আইসোটেক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘আইসোটেক ইলেকট্রিফিকেশন কোম্পানি লিমিটেড’।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করা হলে মাসে প্রায় ১৯ কোটি চার লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়বে ইউনিটপ্রতি ১৩ দশমিক ৬২ সেন্ট। আর জ্বালানি-বহির্ভূত ব্যয় (ক্যাপাসিটি চার্জ এবং অপারেশন ও মেইনটেইনেন্স চার্জ) পড়বে চার সেন্ট। অর্থাৎ গড় উৎপাদন ব্যয় পড়বে ১৭ দশমিক ৬২ সেন্ট বা ১৮ টাকা ৮৪ পয়সা।

অন্যদিকে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে গত ১৭ ডিসেম্বর উৎপাদন শুরু করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি, যা মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নামে পরিচিত। ওই দিন এর ইউনিট-১ থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যোগ হয়। চলতি বছর জুনে ইউনিট-২ থেকে জাতীয় গ্রিড বিদ্যুৎ যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৩৪ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করা হলে মাসে প্রায় ৭৬ কোটি ৫৬ লাখ ৯৭ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় হবে ইউনিটপ্রতি ১৪ দশমিক চার সেন্ট। আর জ্বালানি-বহির্ভূত ব্যয় (ক্যাপাসিটি চার্জ) পড়বে চার দশমিক ৮৫ সেন্ট। অর্থাৎ গড় উৎপাদন ব্যয় পড়বে ১৮ দশমিক ৮৯ সেন্ট বা ২০ টাকা ২০ পয়সা।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। বাংলাদেশের পিডিবি ও ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ করপোরেশন (এনটিপিসি) এর ৫০ শতাংশ করে শেয়ারের মালিক। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ঠিকাদার কোম্পানি ভারত হেভি ইলেক্ট্র্যিালস লিমিটেড (ভেল)। আর এটি নির্মাণে ঋণ দিয়েছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক।

তৃতীয় পর্ব পড়ুন :

সূত্রমতে, সম্প্রতি জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট। গত সপ্তাহে এর পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। তবে আগামী এপ্রিলে মূল উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মিত এস আলম গ্রুপ ও চীনের সেপকো থ্রির যৌথ মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২২৪ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করা হলে মাসে প্রায় ৭৫ কোটি ৯৪ লাখ ৯২ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এতে কেন্দ্রটিতে জ্বালানি ব্যয় পড়বে ইউনিটপ্রতি ১৪ দশমিক ৩৭ সেন্ট। আর জ্বালানি-বহির্ভূত ব্যয় (ক্যাপাসিটি চার্জ এবং অপারেশন ও মেইনটেইনেন্স চার্জ) পড়বে চার দশমিক ৬০ সেন্ট। অর্থাৎ গড় উৎপাদন ব্যয় পড়বে ১৮ দশমিক ৯৭ সেন্ট বা ২০ টাকা ২৯ পয়সা।

অপরদিকে আগামী মার্চে ভারত থেকে আসার কথা আদানির গড্ডা কেন্দ্রের বিদ্যুৎ। ঝাড়খণ্ডে নির্মিত কয়লাচালিত এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করা হলে মাসে প্রায় ৯২ কোটি ৮২ লাখ ৬৮ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এতে কেন্দ্রটিতে জ্বালানি ব্যয় পড়বে ইউনিটপ্রতি ১৮ দশমিক ৩৪ সেন্ট। আর জ্বালানি-বহির্ভূত ব্যয় (ক্যাপাসিটি চার্জ এবং অপারেশন ও মেইনটেইনেন্স চার্জ) পড়বে চার দশমিক ৩৭ সেন্ট। অর্থাৎ গড় উৎপাদন ব্যয় পড়বে ২২ দশমিক ৭১ সেন্ট বা ২৪ টাকা ২৯ পয়সা।

২০১৭ সালের নভেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে পিডিবি সঙ্গে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের চুক্তি সই হয়। ভারতের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত ১০৫ দশমিক ৯ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে জাতীয় গ্রিড পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের কমিশনিং সম্পন্ন হয়েছে। গত ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ গ্রিড থেকে ব্যাকফিড পাওয়ার প্রদান করা হয়েছে। আর গত ১০ ডিসেম্বর কেন্দ্রটি থেকে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।