প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

‘আমার উদ্যোগে ছয়টি পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে’

আসমা হক কান্তা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ও এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৫ সালে চালু করেন ‘ধবল’ নামে একটি অনলাইন শপ। বর্তমানে ধবলের মাধ্যমে খাঁটি খাদ্যপণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন ভোক্তাদের কাছে। সম্প্রতি শেয়ার বিজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার এ উদ্যোগ সম্পর্কে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামসুন নাহার

চাকরি না করে উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা কেন করলেন?

অনার্স শেষ হওয়ার আগে ২০০৮ সালে অক্সফামের প্রজেক্ট অফিসার হিসেবে যোগ দিই। পরে কয়েকজন মিলে ‘প্রাণন’ নামে একটি আইটি প্রতিষ্ঠান গঠন করি। পাশাপাশি একটি অনলাইন বুটিক শপ চালু করি। আরও আগে থেকেই ব্যবসায় সম্পৃক্ত হওয়া

র ইচ্ছা ছিল। তবে গুছিয়ে কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। মনে মনে উদ্যোক্তা হওয়ার দৃঢ় সংকল্প ছিল। চিন্তা ছিল ১০-১২ বছর চাকরি করে টাকা জমিয়ে ব্যবসা শুরু করবো।

বিয়ের পর ঢাকায় চলে আসি। একবার টাঙ্গাইল থেকে আমার শাশুড়ি গরুর দুধ নিয়ে এসেছিলেন। ঢাকায় খাঁটি দুধ একেবারেই দুষ্প্রাপ্য। তাই ব্যবসায়িকভাবে ঢাকায় খাঁটি দুধ সরবরাহ করার পরিকল্পনা করে ফেলি। ফেসবুকে পোস্ট দিই ‘শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি খাঁটি গরুর দুধ আনতে। কে কে নিতে চান?’ এতে দারুণ ফিডব্যাক পাইÑপ্রায় ৪৮ লিটার দুধের অর্ডার পাই তখন। এরপর টাঙ্গাইল, কেরানীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দেশি গরুর দুধ সংগ্রহ করি। কেরানীগঞ্জে একটি উন্নত মানের ফার্মের খোঁজ পাই। সেখানে আমাদের ডেলিভারিম্যান যাওয়ার পর দুধ দোহন করা হয়। এক মেয়েকে খুঁজে পেলাম, তিনি ভালো ঘি তৈরি করতে পারেন। আরেকটু নেটওয়ার্কিং করে এক মামাকে পেলাম যিনি সরাসরি মৌয়ালদের কাছ থেকে মধু সংগ্রহ করেন। আরেক মামা বাগেরহাট থেকে নিজের মিলে নারিকেল ভেঙে তেল পাঠানো শুরু করলেন। মসলা আমি নিজেই কিনি। ঝেড়ে, ধুয়ে ও ছাদে শুকিয়ে বাসার পাশের কল থেকে গুঁড়ো করে আনি। ধীরে ধীরে আচার ও পিঠা যোগ করলাম। এখন চিকেন নাগেট, কাটলেট ইত্যাদি ফ্রোজেন ফুডও সাপ্লাই দিই।

এভাবে একটু একটু করে যেখানে সেরাটা পেয়েছি, ধবলের তালিকায় তুলে নিয়েছি। সব ক্ষেত্রেই শতভাগ শুদ্ধতা নিশ্চিত করেছি। এমনকি এখানে আমি যাদের নিজে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ করাই, তাদের ওপরও পুরোপুরি ছেড়ে দিই না। নিজে উপস্থিত থেকে তদারক করি।

ব্যবসার পেছনে মূল অনুপ্রেরণা কী?

পড়াশোনা শেষ করার আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল উদ্যোক্তা হবো। মানুষ নিয়ে কাজ করতে আমার ভালো লাগে। নিজে একটি ব্যবসা চালাচ্ছি, এতে একটা ভালোলাগা তো আছেই। এর চেয়ে বড় কথা হলো, আমার এ উদ্যোগের কারণে ছয়টি পরিবার স্বাবলম্বী হতে পেরেছে। এটাই আমার বড় অর্জন। এছাড়া আমার পরিবারের সহায়তা বরাবরই ছিল। বিশেষ করে আমার স্বামী আমাকে নানাভাবে সাহায্য করে চলেছেন।

আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার আপনার ব্যবসায় কীভাবে সহায়ক হয়েছে?

আমার প্রতিষ্ঠান ধবল একটি অনলাইন শপ। তাই এটি পুরোপুরি যোগাযোগ প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে ন্যূনতম খরচে আমি পণ্য প্রচারের কাজ করতে পারি। ৯০ শতাংশ অর্ডার ফেসবুকেই আসে। কম খরচে অনেক বেশি লোকের কাছে ধবলকে উপস্থাপন

dhobolকরা অন্য কোনো মাধ্যমে সম্ভব হতো না। অবশ্য এর কিছু ঝুঁকিও আছে। যেমন পণ্যের নির্দেশিকা না মানার কারণে কোনো পণ্য মেয়াদের আগে নষ্ট হয়ে গেলে ক্রেতা বা ভোক্তা সরাসরি পেজে এসে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এতে আমাদের ভোক্তা ও শুভানুধ্যায়ীদের মনে ধবল সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব তৈরি হতে পারে। তবু মনে করি, ক্রেতারা আরও সচেতন হলে যোগাযোগ প্রযুক্তি আমাদের জন্য আশীর্বাদের।

ব্যবসাকে বড় পরিসরে নেয়ার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে চান?

আসলে আমার এ উদ্যোগ এখনও প্রকৃত অর্থে ব্যবসা নয়, বরং পরিবারে বাড়তি আয়ের উৎসের পর্যায়ে রয়েছে। ধবলকে এসএমইর পর্যায়ে নেওয়ার স্বপ্ন অবশ্যই আছে। এজন্য প্রয়োজন বড় অঙ্কের মূলধন। এছাড়া হোমমেড হওয়ায় ধবলপণ্যের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এ পণ্য আরও বড় পরিসরে কারখানায় উৎপাদন করতে গেলে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার অনুমোদনসহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা দরকার। এসব কাজ যতটা না ব্যয়বহুল, তার চেয়ে অনেক বেশি ঝামেলার। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি সমস্যার কারণে আমরা স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি না।

বিভিন্ন ব্যাংক এসএমই খাতে অনেক সহায়তা করে। এর সুযোগ নিয়ে মূলধন সমস্যা দূর করা যায় না?

ব্যাংকগুলো লোন বরাদ্দ দেয় ঠিকই কিন্তু জামানত পলিসির কারণে আমরা অনেকে আটকে যাই। আমি নিজেও এসএমই খাতে জামানতবিহীন লোন নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ সম্পর্কে জেনে একটি ব্যাংকে যাই। সেখানে দেখেছি, ব্যাপারটি অত সহজ নয়। অনেকেরই ঋণ মঞ্জুর হয়নি। অর্থাৎ কাগজকলমে যে নিয়মনীতি তৈরি হয়, তা নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে যথেষ্ট সহায়ক। কিন্তু বাস্তব অবস্থা আমাদের জন্য ততটা অনুকূল নয়।

একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার বড় চ্যালেঞ্জ কী?

নারী বা পুরুষ যে কোনো উদ্যোক্তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূলধন জোগাড় করা ও পণ্যের মান ঠিক রাখা। যেমন ছোট পরিসরে বাড়িতে বসে হাতে তৈরি খাদ্যপণ্যের স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ কিছুটা হেরফের হতে পারে। তবে যে কোনো উপায়ে পণ্যের মান ঠিক থাকলে ভোক্তাদের আস্থা অর্জন সম্ভব।

নারী হয়েও ব্যবসার উদ্যোগ নেওয়ায় পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা আসেনি বরং সহায়তা পেয়েছি। তাছাড়া আমি মনে করি অর্জিত জ্ঞান ও কর্মদক্ষতা কাজে লাগানো একজন নারীর কেবল অধিকারই নয়, দায়িত্বও। এ দায়িত্ব নিজের, পরিবারের ও দেশের প্রতি। একজন নারীর জন্য ব্যবসা শুরু করা যে আলাদা কিছু সেই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

আজকাল তরুণদের মধ্যে চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে বেশি। এত উদ্যোগ সফল করার সামর্থ্য বাংলাদেশের অর্থনীতির আছে কি না?

অবশ্যই নেই। সেই প্ল্যাটফর্ম এখনও তৈরি হয়নি। মানতে হবে, বড় হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কিন্ত একটি মধ্যম আয়ের দেশে যে বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত, তা আমাদের নেই। একজন উদ্যোক্তা ও অর্থনীতির ছাত্রী হিসেবে আমি দেখেছি, বিভিন্ন দেশে কোনো নতুন উদ্যোক্তা চাইলে একজন অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর বা পৃষ্ঠপোষক পেতে পারেন। আমাদের দেশে এ মনোভাবের বড় অভাব। যাদের পর্যাপ্ত মূলধন আছে তারা অন্যদের সুযোগ না দিয়ে নিজেরাই একচেটিয়া ব্যবসা করছেন। ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারবেন না। ফলে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে দূরত্ব দিন দিন বড় হচ্ছে। অথচ এসএমই নিয়ে কেবল অনুপ্রেরণা পর্যায়ে কিছু কাজ হচ্ছে, সহায়তা দেওয়া ও পৃষ্ঠপোষকতা পর্যায়ে নয়। আরেকটি বড় সমস্যা হলো অবকাঠামো। যানজট ও রাস্তাঘাটের করুণ অবস্থা কাঁচামাল সংগ্রহ, ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি কাজে ভোগান্তি ও আর্থিক ক্ষতি হয়। সর্বোপরি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে সরকারি পর্যায় থেকে দুর্নীতি রোধ করা প্রয়োজন, যাতে ভোগান্তির শিকার হয়ে কোনো উদ্যোক্তাকে পিছিয়ে থাকতে না হয়। তাহলে এত উদ্যোগকে সাপোর্ট দেওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।