বিপ্লব আলী : আরব বিশ্বের সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ২০১১ সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই সময় আরব বসন্তের সূত্রপাত হয়েছিল। যদিও উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের সূতিকারাগার বলা হয় পরবর্তী সময় আরব বসন্ত মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তার লাভ করে। আরব বিশ্বে বিভিন্ন দেশ তথা, মিসর বাহরাইন ইয়েমেন, লিবিয়ায় রাষ্ট্রনায়কদের পতন হতে থাকে। প্রথমে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট এল আবেদিন বেন আলির, মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের, লিবিয়ায় মুয়াম্মর আল-গাদ্দাফি ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহের জমানার অবসান হয়। আরব বিশ্বের এই গণ-অভ্যুত্থান সংঘটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমি রেখেছিল। কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্র্যচ্যে ইসরায়েলের লবিস্ট হিসেবে কাজ করে চলছে। এই ধারাবাহিকতায় আরব বিশ্বে ইসরাইলবিরোধী যে কোনো দেশের সরকার হয়তো খুব বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারে না।
আরব বসন্তে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের পতন হলেও স্রোতের প্রতিকূলে শক্ত অবস্থানে রয়েছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। যখন একের পর এক জনগণের রাজনৈতিক আন্দোলন ও পশ্চিমা বিশ্বের ইন্ধনে সরকার পতন হতে থাকে তখন একমাত্র সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তিশলী দেশ ইরান ও পূর্ব ইউরোপের পারমাণবিক শক্তিশালী দেশ রাশিয়া। আরব বসন্তের ফলে সিরিয়ায় যে গৃহযুদ্ধ সূচনা হয়েছিল তাতে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সব থেকে প্রভাবশালী সংস্থা, আরব লিগ থেকে সিরিয়াকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এছাড়া সিরিয়ার সেনাবাহিনী একাংশ প্রশ্চিমা শক্তির ইন্ধনে বাশার আল আসাদের বিপক্ষে আবস্থান করে; যা পরবর্তী সময় ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ নামে বাশার আল আসাদের বিপক্ষে যুদ্ধ শুরু করেছিল। আর এই ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবসহ বেশ কিছু দেশ যুদ্ধাস্ত্র ও অর্থনৈতিকভাবে সহযোগী করতে থাকে। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সিরিয়ার জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি ২২ লাখ। সংঘাত শুরু হওয়ার পর এর অর্ধেক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রায় ৬৮ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং আরও ৬০ লাখ মানুষ শরণার্থী বা বিদেশে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন।
পিতা হাফিজ আল আসাদ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কূটনীতিক ক্ষমতায় ৩০ বছর সিরিয়া শাসন করেছেন। তাই পরিবার থেকে রাজনীতি হাতেখড়ি পিতার মতো বাশার আল আসাদ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী। কীভাবে গণআন্দোলন পতিহত, দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিহিংসা প্রতিরোধ ও বৈদেশিক তথা পশ্চিমা বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকিয়ে থাকার কৌশল তিনি খুব ভালো করে রপ্ত করেছেন। যদিও তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অনেক অভিযোগ থাকলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভারসাম্য রক্ষা করে আরব বিশ্বে আঞ্চলিক শক্তি ইরানের প্রভাব পাকাপোক্ত করেছেন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ দীর্ঘ একদশকের বেশি সময় ধরে চলতে থাকলেও এখন মধ্যেপ্র্যাচ্যে শান্তির সুবাতাস বয়ে চলছে। গত ১৯ মে আরব লিগের অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ আরব লিগে পুনরায় যোগদান করেন। এর ফলে সিরিয়াকে আরব দেশগুলো নতুন করে গ্রহণ করেন।
মূলত গত ৬ ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক এবং উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় আঘাত হানা বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে সিরিয়ার সম্পর্ক ত্বরান্বিত হয়। সে সময় একসময়ের শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলো সিরিয়ার সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মানবিক সাহায্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আবার চীন গত ১০ মার্চ মাসে এক শান্তিচুক্তিতে মধ্যস্থতা করে; যাতে সৌদি আরব তার দীর্ঘদিনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্ব^ী ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনস্থাপন করে। আর সৌদি-ইরান কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে দিয়ে আরব বিশ্বে নতুন রাজনৈতিক মেরূকরণ সৃষ্ট হয়েছে; যা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতপূর্ণ দেশগুলো সুসম্পর্কের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইরান রাশিয়ার সঙ্গে মিলে বাশাল আল আসাদের বাহিনীকে সিরিয়ার বৃহত্তম শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে। তবে সিরিয়ার একটি বড় অংশ এখনও তুর্কি-সমর্থিত বিদ্রোহী, জিহাদি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি-নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া যোদ্ধাদের দখলে রয়েছে।
তবে সবকিছু উপেক্ষা করে বাশার আল আসাদ যেভাবে সিরিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকিয়ে রয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। তবে দীর্ঘদিন চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ অবসানের পথ সুগম হয়েছে। সৌদি-ইরানের কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপন ও আরব বিশ্বে চীনের উপস্থিতি বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে শান্তি বয়ে চলেছে। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ স্থায়ীভাবে আবসান হবে কি না, এই বিষয় বিবিসির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফেরাসি কিলানি বলেন,”একনায়ক আসাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলন একসময় নিষ্ঠুর গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকা চলে যায় প্রেসিডেন্ট বাশারের বিরোধী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু বিরোধী গ্রুপগুলো বর্তমানে তুরস্কের সঙ্গে সীমান্তে খুবই ছোট্ট একটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৭ সালে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের পতনের পর থেকে স্বশাসিত কুর্দি অঞ্চল ছাড়া বাকি সিরিয়া চলে গেছে প্রেসিডেন্ট আসাদের নিয়ন্ত্রণে। বাশার আল-আসাদকে আরব লিগে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি দেশটির বাস্তব পরিস্থিতিরই স্বীকৃতি। এর অর্থ এই নয়, রাতারাতি অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। তবে আমার মনে হয় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার শেষ পান্থে রয়েছে। কেননা আরব বিশ্বে প্রতিনিধিত্ব দেশ সৌদি আরব এখন পশ্চিমা শক্তিকে প্রায় উপেক্ষা করে চীন ও রাশিয়া বলয়ের পথে ধাবিত হচ্ছে। এই পেক্ষাপটে সিরিয়াকে আরব লিগে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে ইসরাইল যা আরব বিশ্বে ক্যান্সার নামে পরিচিত অনেকটাই ব্যাকফুটে পড়েছে। কেননা যখন মধ্যেপ্রাচ্যের বিবদমান দেশগুলো যথা ইরান, সৌদি আরব, সিরিয়া ও ইয়েমেন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে তখন তেল-আবিব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থা করে চলেছে। আরব দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে ইসরাইল নিরাপত্তাহীনতায় থাকবে; এভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার আরব লিগে যোগদানের কট্টর সমালোচনা করেছেন। এছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর বারবার মানবাধিকার প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে। তবে আসাদ সরকার মানবাধিকারের সম্মুখে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তিনি আরব বসন্ত, পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ বিরোধ, আইএস, কুর্দি ও ইসরাইলের লবিস্টদের পরাজিত করে নিজের অবস্থান আরব বিশ্বে সুদৃঢ় করেছেন।
মুক্ত লেখক
রাজশাহী