ফারুক আলম, লালমনিরহাট: উর্বর ভূমির জেলা লালমনিরহাট। এখানকার ফসলি জমিগুলো বেশিরভাগই তিন-চার ফসলি। জেলার বিস্তৃর্ন চরাঞ্চলে খসখসে বালুর মধ্যেই ফলে হরেক ফসল। আর এই চরাঞ্চলের প্রধান ফসল ভুট্টা আর ধান। প্রতি বিঘায় ভুট্টার গড় উৎপাদন ৫৫ মণের বেশি, আর ধানের ফলন প্রায় ত্রিশ মণ। প্রাকৃতিক নানান ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করেই ফসল ফলান এখানকার কৃষকরা। বান-খরা আর কীট-বালাই মোকাবেলাতেই যখন কৃষকরা দিশেহারা, তখন নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ইটভাটা। প্রতিনিয়ত হাজার হাজার বিঘার ফসল পুড়িয়ে ফেলছে ইটভাটার গরম বাতাস। এতে পুড়ে গেছে ধান, মরে যাচ্ছে ঘাস, সুপারির মত গাছেরও ডগা পড়ছে খসে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার বেশিরভাগ ইটভাটাগুলো গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ কৃষি জমির উপর, যার পাশেই আছে ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা। এসকল ভাটার ধোঁয়া ফসলে হানা দেয়ায় কৃষকদের মধ্যে হতাশা ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিক্ষুব্ধ কৃষকদের সড়ক অবরোধের মতো ঘটনাও ঘটেছে। উপায়ন্তর না পেয়ে কৃষকরা দুটি ইটভাটার বেচাবিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা প্রশাসনগুলোকে জরিপ ও ক্ষতি নিরুপনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কৃষকরা বলছেন, তাদের ক্ষেতের ধান, ভুট্টা আর মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ঘরে তোলার কথা রয়েছে। কিন্তু ইট ভাটার ধোঁয়ার কারণে সব চিটা হয়ে গেছে। এক আনা সুস্থ ফসলও তারা ঘরে তুলতে পারবেন না।
দুর্গাপুরের কৃষক আলী হোসেন বলেন, ‘ভাটার গ্যাস এক সাথে ছেড়ে দিয়েছে। গরম বাতাসে ধান- সবজি সহ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সুপারি গাছের আগাল (ডগা) ভেঙে ভেঙে পড়ছে।’
একই এলাকার কৃষক আবুল কালাম বলেন, ‘দুই দোলার (বিল) প্রায় দেড় হাজার একরের ধান নষ্ট হয়েছে। তেমনই আবু কালাম, শহিদুল, একরামুল, জাহেদুলরা বন্ধকি জমি চাষ করেছেন। তাদের জমিগুলো দুই উপজেলায় পড়েছে। তারা সদর উপজেলা ও আদিতমারী কৃষি কর্মকর্তার কাছে নালিশ করেছেন। ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা একজন উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা এসে ফসলের দূরবস্থা দেখেও গেছেন। কিন্তু এখনও কোনো তদন্ত বা সহায়তা তারা পাননি।’

ওই এলাকার শফিকুল ইসলাম বলেন,‘ আমি কৃষক। আমার সংসার চলে ফসল বেঁচে। যে ধোঁয়া ৭ দিনে ছাড়ার কথা, সেটা এক দিনেই ছেড়েছে। এই কারণে জমির ধান ও ভুট্টা পুড়ে গেছে।’
হাতিবান্ধা উপজেলার মতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমার ২০ বিঘা জমির ধান পুড়ে গেছে। কারও ১৫ থেকে ২০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়েছে। আমাদের প্রায় দুই হাজার বিঘার ধান নষ্ট হয়েছে।’
নথি সূত্র বলছে, লালমনিরহাট জেলায় ২৩ টি ইটভাটা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটিকে ইতিমধ্যে অবৈধ দেখানো হয়েছে। পাটগ্রাম উপজেলার ২টি ইট ভাটা, দুটোই বৈধ। হাতিবান্ধার ৪টি ইট ভাটার তিনটিকে বৈধ দেখানো হয়েছে। একটির কোনো তথ্য নেই। কালিগঞ্জের ৬টি ইট ভাটার ৪টি জনবসতিপূর্ণ এলাকায়, ২টিকে দেখানো হয়েছে কৃষি জমির উপর। আদিতমারী উপজেলায় ৬টি ভাটার তিনটি জনবসতিপূর্ণ এলাকায়, কৃষি জমির উপর একটি, তথ্য নেই বাকি দুটি ইটভাটার। সদর উপজেলার ৫টি ইটভাটা। তিনটি কৃষি জমির উপর, একটি জনবসতিপূর্ণ এলাকায়, তথ্য নেই একটি ইটভাটার।
পরিবেশ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক রাইহান হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। এটা আমাদের রুটিন কাজ। তবুও কোনো ইটভাটা সমস্যা তৈরি করলে, আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিবো। ইমেইল, ডাক, ফোন, স্বশরীওে যেকোন ভাবে যে কেউ অভিযোগ করলে দ্রুত ব্যবস্থা নিবো।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, এত সব ক্ষতির কারণ আপাতত ৪টি ইট ভাটা। আদিতমারীর ওয়ান স্টার ব্রিকস, লালমনিরহাটের টু স্টার ব্রিকস, হাতিবান্ধার এ এমবি ব্রিকস, দুর্গাপুরের একটি ইটভাটা।
টু স্টার ব্রিকস এর ব্যবস্থাপক মমিন বলেন, ‘আমরা আমাদের স্বাধ্যমত আলাপ আলোচনার মাধ্যমে কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে দিবো। উপজেলা কৃষি কর্মকর্কার সাথে আমরা জরিপ করে ক্ষতিপূরণ দিবো।’
এএমবি ব্রিকস, ওয়ান স্টারের ব্রিকস এর ব্যবস্থাপকদের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। ওয়ান স্টার ব্রিকসের ক্যাশ মেমোয় থাকা মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, এটি ওয়ান স্টার ব্রিকসের নাম্বার নয়। বরং ওয়ান স্টার ব্রিকস তার নম্বর অবৈধভাবে তাদের ক্যাশ মেমোতে ব্যবহার করেছে। কোনো ইট ভাটার সাথে তার সম্পর্ক নেই।
এ বিষয়ে আদিতমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আলীনূর শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা বিষয়টা শুনেছি। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের জন্য প্রনোদনার ব্যবস্থা করবো। আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে তদন্ত করা হবে। আমাদের প্রতিবেদনে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন। আমাদের দপ্তর আন্তরিকতার সাথে বিষয়টা দেখবে।
হাতিবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজির হোসেন বলেন, এবিষয়ে কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। লালমনিরহাটের ডিসি আবু জাফর শেয়ার বিজকে বলেন, ইট ভাটার গরম বাতাসে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। উপজেলাগুলোকে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। তারা তদন্ত প্রতিবেদন দিলেই ইটভাটার মালিকদের থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে দেয়া হবে। এটা আমরাই করে দিবো। পরিবেশ অধিদপ্তরকেও বলা হয়েছে। কৃষি বিভাগ যদি প্রনোদনা দেয়, সেটা ভালো। তারা তা করতে পারে। আমরা আমাদের মত করে কৃষকদের ক্ষতির বিষয়টা বিবেচনা করবো।