মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: প্রতি বছর রমজানের শুরুতে ঈদের কেনাকাটা শুরু হওয়ার পরেই ছিট কাপড়ের বাজারেও বিক্রি বেড়ে যায়। ক্রেতারা তাদের রুচিসম্মত পোশাক তৈরির জন্য ছিট কাপড় কিনে নেন। এ বছরও ঈদুল ফিতর সামনে রেখে রমজানের শুরুতে ক্রেতাদের ভিড় জমেছে যশোরের ছিট কাপড়ের দোকানগুলোতে। এ সময় ছিট কাপড় কিনে দর্জির দোকানগুলোতে পোশাক বানাতে দেয়ার তাড়া থাকে। তবে দাম বৃদ্ধির কারণে চরম অসন্তুষ্টি বাজারে আসা ক্রেতাদের মাঝে।
একদিকে ছিট কাপড়ের দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে টেইলার্সের মজুরি বৃদ্ধির কারণে বাড়তি খরচ গুনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ক্রেতাদের। ক্রেতারা বলছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ছিট কাপড় প্রতি গজ প্রকার ও গুণগত মান ভেদে দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ২০০ টাকা। আর দাম বাড়ায় বেচাকেনা তুলনামূলক কম হচ্ছে বলেও ব্যবসায়ীরা জানান।
গতকাল মঙ্গলবার যশোর বড়বাজারের কাপুড়িয়াপট্টি এলাকার ছিট কাপড়ের দোকানগুলোতে দেখা যায়, ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। তবে ক্রেতার উপস্থিতি থাকলেও বেচাকেনা নেই বললে চলে। অনেকে ইচ্ছার বাইরে কেনাকাটা করলেও দাম নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন। ক্রেতাদের অভিযোগ অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর দেশি কাপড়ে ৪০ শতাংশ ও বিদেশি কাপড়ে ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ দাম বেড়েছে। কোনো কোনো কাপড়ের ক্ষেত্রে তিনগুণ দাম বেড়েছে।
যশোর বড়বাজার ছিট বিতানের বিক্রয় প্রতিনিধি শরিফুল ইসলাম বলেন, রমজান উপলক্ষে প্রতি বছর যে বেচাকেনা থাকে সে তুলনায় এবার খুবই খারাপ। প্রতিটি কাপড়েই ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। বিদেশি শার্ট-প্যান্টের পিসে গজ প্রতি ৫০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়ছে। পায়জামা-পাঞ্জাবির কাপড়ের গজ প্রতি প্রকার ও মানভেদে বেড়েছে ৫০ থেকে ২০০ টাকা। মেয়েদের দেশি-বিদেশি সালোয়ার কামিজের কাপড়েও বেড়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। তিনি বলেন, পাইকার বাজার থেকে বলা হচ্ছে, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সুতা উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে পরিবহন খরচ সবমিলে কাপড়ের বাজারে প্রভাব পড়েছে।
লতিফ ক্লথ স্টোরের বিক্রয় প্রতিনিধি সাজিদুল হাসান মিন্টু বলেন, রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই ছিট কাপড়ের বেচাকেনা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এ বছর ব্যতিক্রম। মানুষ বাজারে আসছে বটে। তবে দেখেশুনে দাম যাচাই-বাছাই করে চলে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি। তিনি বলেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর দেশি কাপড়ের দাম ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ আর বিদেশি কাপড় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। বেশি দাম বেড়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ের। কোরিয়ান মাইক্রো পাঞ্জাবির সুতি কাপড়ের দাম আগে গজপ্রতি ১৫০ টাকা বিক্রি হলেও এবার তা বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা। ১১০ টাকার দরে কাপড় বিক্রি হচ্চে গজপ্রতি ১৬০ টাকা।
একই কথা বলেন, মডার্ন ক্লথ স্টোরের ম্যানেজার হারান মজুমদার। তিনি বলেন, সব ধরনের ছিট কাপড়ের দাম বেড়েছে। তবে বিদেশি গর্জিয়াস কিছু আইটেম আছে সেসব কাপড়ের দাম গজপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এলসি সমস্যার কারণে এসব কাপড়ের দাম বেড়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
এদিকে কাপড়ের দামের পাশাপাশি টেইলার্সের দোকানে কাপড় তৈরির মজুরিও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কাপুড়িয়াপট্টি এলাকার মডার্ন টেইলার্সের মালিক রুহুল আমীন বলেন, ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ, শ্রম খরচের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের মজুরিও বাড়াতে বাধ্য হতে হয়েছে। আগে প্যান্টের মজুরি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা নেয়া হলেও এ বছর ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। স্যালোয়ার কামিজের মজুরি আগে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা নেয়া হলেও এখন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। আর ৩০০ টাকার পাঞ্জাবির মজুরি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এরপরও কারিগররা কাজ করতে চাচ্ছে না। তারা আরও বেতন বাড়াতে বলছে।
সানমুন টেইলার্সের মাহবুব হোসেন বলেন, কাপড়ের ও দর্জির দোকানের খরচ বেশি হওয়ায় অনেক ক্রেতাও ঈদের পোশাক তৈরিতে কাটছাঁট করছে। যে কারণে অন্যান্য বছরে যে হারে অর্ডার আসত, এ বছর এখন পর্যন্ত তেমন অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, অন্যান্য বছরে আমরা ১০ রমজানের পরে অর্ডার নিতাম না। এ বছর অনেকটা ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে।
দাম বৃদ্ধির কারণে ক্রেতাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা যায়। তাদের দাবি ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বড় বাজারে কথা হয় শারমীন আকতার নামে এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, নতুন জামাইয়ের জন্য শার্ট-প্যান্টের কাপড় কেনার জন্য বাজারে এসেছিলাম। কিন্তু যে দাম তাতে রেডিমেড তৈরি পোশাক কিনবো কিনা ভাবছি। তিনি বলেন, প্রতিটা জিনিসই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মানুষ এ বছর কীভাবে ঈদ উদযাপন করবে তাই চিন্তা করছি।
বাজারে আসা আমেনা বেগম নামে আরেক ক্রেতা বলেন, সাধারণত দেশি ভয়েল কাপড় যেগুলো আমরা সচরাচর ব্যবহার করি তাতেও গজপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা দাম বেড়েছে। গরিবের কাপড় বলে পরিচিত ট্যাট্রন-পলেস্টার কাপড়েও গজপ্রতি ৫০ টাকা বেড়েছে। সঙ্গে দর্জির খরচও বেড়েছে। এ অবস্থায় কীভাবে ছেলেমেয়েদের ঈদের পোশাক বানিয়ে দেবো তাই চিন্তা করছি। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের যে দাম তাতে বাচ্চাকাচ্চাদের কিছু কিনে দিতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।