প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

‘উন্নয়নের অংশীদার হতে চায় এনআরবিসি ব্যাংক’

প্রবাসী উদ্যোক্তাদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক লিমিটেড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আবেদন গ্রহণ শুরু। দীর্ঘ ১২ বছর পর কোনো ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চলেছে। ব্যাংকটির পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত হওয়ার প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য ও ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা নিয়ে সম্প্রতি শেয়ার বিজের সঙ্গে কথা বলেছেন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এসএম পারভেজ তমাল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জয়নাল আবেদিন

শেয়ার বিজ: অন্যান্য ব্যাংক থেকে আপনাদের সেবার পার্থক্য কী? আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

পারভেজ তমাল: আমরা যারা উদ্যোক্তা শোযারহোল্ডার রয়েছি, তাদের একটা আলাদা উদ্দেশ্য আছে। আমরা দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাই। পাশাপাশি দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করতে চাই। ব্যাংক সেক্ষেত্রে বড় একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখান থেকে দেশের মানুষের জন্য কাজ করা যায়; শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করা যায়। ব্যাংক বড় ধরনের সেবাকেন্দ্র, যেটা ব্যবহার করে মানুষ বিভিন্ন সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারে। আপনারা জানেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে ব্যাংক মুনাফার ১০ শতাংশ ব্যয় করে। আমরা এ অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন দুর্যোগে ব্যয় করে থাকি। করোনা মহামারির মধ্যে আমাদের কার্যক্রমগুলো আপনারা দেখেছেন। আমরা সেই সময়ে সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ জরুরি কাজে নিয়োজিতদের সুরক্ষা সামগ্রী দিয়েছি। চিকিৎসকদের সমন্বয়ে আমরা কল সেন্টার করেছি। বিভিন্ন প্রত্যন্ত উপজেলায় করোনা পরীক্ষার বুথ স্থাপন করেছি। এসব উদ্যোগের ফলে আমাদের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ পেয়েছে। আমরা ৮৩টি শাখার মাধ্যমে সেবা দিচ্ছি, আর বিআরটিএ ও ভূমি নিবন্ধন বুথসহ ৪০০টি উপশাখা ও ৫৮৯টি এজেন্ট বুথের মাধ্যমে একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষদের পাশে গিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় সেবা দিচ্ছি। এখানেই অন্য ব্যাংকের সঙ্গে এনআরবিসি ব্যাংকের পার্থক্য।

শেয়ার বিজ: দীর্ঘ ১২ বছর পর কোনো ব্যাংক পুঁজিবাজারে আসছে। এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ কী থাকছে?

পারভেজ তমাল: সব তফসিলি ব্যাংক পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। আর পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির শর্তই থাকে পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত হওয়া। যেহেতু সাধারণ মানুষের অংশীদার হতে হবে, তাই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। ব্যাংকের অনুমোদন প্রাপ্তির সময়ই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার সময়সীমা নির্দিষ্ট করা ছিল। কিন্তু নানা কারণে আমরা আসতে পারিনি। তবে ২০১৮ সালের শেষদিকে আমরা পুঁজিবাজারে আসার বিষয়ে আবেদন করি। একটা লম্বা প্রক্রিয়া শেষে গত নভেম্বরে অনুমোদন পাই। তবে করোনা মহামারি না থাকলে আমরা আগেই আসার সুযোগ পেতাম। পুঁজিবাজারে আসার ক্ষেত্রে আমাদের উদ্দেশ্যে হচ্ছে প্রকৃত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ও সাধারণ মানুষের ব্যাংকে পরিণত হওয়া। তালিকাভুক্ত হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি আমরা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নিয়ন্ত্রণে আসব। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতি আমাদের জবাবদিহি বাড়বে এবং ব্যাংকের করপোরেট সুশাসনের মান বৃদ্ধি পাবে। আমি মনে করি, একটি ব্যাংক তখনই ভালো করতে পারে, যখন তার করপোরেট সুশাসন ও কমপ্লায়েন্স ভালো থাকে।

আমাদের সত্যিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে, বিভিন্ন আর্থিক ও সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসছেÑতার অংশীদার হওয়া; মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সম্পৃক্ত থাকা। আমরা নিচের স্তরে ব্যাংকিং করতে চাই এবং সেই উদ্দেশ্য নিয়েই পুঁজিবাজারে আসছি। আমাদের নতুন চিন্তাভাবনা গ্রাম থেকে শহর, তৃণমূলে বিভিন্ন কালেকশনের (অর্থ সংগ্রহ) সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং বেশি বেশি মানুষকে সম্পৃক্ত করা। বৃহৎ ঋণ বিতরণে এখন আমরা খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, বিনিয়োগে উৎসাহিত করা, সিএমএসএমইতে থাকা ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।

বছর শেষে লভ্যাংশ পাওয়াই একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগের মূল উদ্দেশ্যে নয়। একটি ব্যাংক বা কোম্পানি দেশের জন্য কতটুকু উপকারি সেটাও, বিবেচনায় রাখতে হবে। কর্মসংস্থান তৈরির জন্য আমরা দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ করব, যেখানে বিনিয়োগ হবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়। এখানে বিতরণ করা ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কাও কম। পুঁজিবাজারে এসে ব্যাংকে বিনিয়োগ করলে লভ্যাংশ পাওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবেও শান্তি পাবেন বিনিয়োগকারীরা। জনসাধারণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে আমরা একটা ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ তৈরি করতে চাই।

শেয়ার বিজ: পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে আপনাদের পরিকল্পনা কী? ওই অর্থ কোথায় বিনিয়োগ করতে চান?

পারভেজ তমাল: আপনি জানেন, আমরা ৪৪৬ কোটি টাকা দিয়ে যাত্রা করি। এখন মূলধন ৫৭১ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি জনগণের জমানো অর্থ আছে ১০ হাজার কোটি টাকা। তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদনের সময় আমাদের চিন্তা করতে হয়েছে পুঁজিবাজারে চাপ সৃষ্টি হবে কি না। তবে এ মুহূর্তে পুঁজিবাজার বেশ সচল। নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে, নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনাও বাড়ছে। অনেক কোম্পানি ভালো করছে এবং তাদের শেয়ারে তেজিভাব আছে। বাজার থেকে থেকে আমাদের ১২০ কোটি আসবে। সার্বিকভাবে এটি আমাদের ব্যাংকের জন্য খুব বড় অঙ্ক নয়। কারণ আমরা ১০ হাজার কোটি টাকার আমানত নিয়ে কাজ করি। আমরা এ ১২০ কোটি টাকার কিছু আইপিওর কাজে ব্যবহার করব, বন্ডে বিনিয়োগ করব এবং সেকেন্ডারি মার্কেটেও থাকবে। আমরা নিচের দিকের ব্যাংকিং, বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণ এবং রিটেইল ব্যাংকিংয়ে এ অর্থ কাজে লাগাব। এ বিনিয়োগটা হবে সুদূরপ্রসারী ও কাঠামোগত। কারণ আমরা চাচ্ছি, আমাদের ব্যাংক অনেক মানুষকে ঋণ দেবে। আমরা আসলে এমন না যে, আমরা একজন গ্রাহককে ঋণ দেব, স্বল্পসংখ্যক মানুষের জন্য কাজ করব। আমরা কিন্তু এখন ৫০০ স্থানে ব্যাংকিং করছি, যার ৭৫ শতাংশই গ্রামে। আমরা গ্রামের মানুষদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। ক্ষুদ্রঋণ ও সিএমএসএমই ঋণেই থাকতে চেষ্টা করব। এ চিন্তা-ভাবনা নিয়েই পুঁজিবাজারে আসা। বেশি বেশি মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা গড়ে তুলব, এমন চিন্তা-ভাবনা আছে।

শেয়ার বিজ: কর্মস্থান সৃষ্টিতে শিল্পায়নের জন্য বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংক কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে?

পারভেজ তমাল: দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করার জন্য পুঁজিবাজারই প্রধান জায়গা। কিন্তু বাংলাদেশে গত এক যুগে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তাতে প্রধান ভূমিকাই রেখেছে বেসরকারি ব্যাংক। তারা এগিয়ে এসেছে, সাহস দেখিয়েছে। পদ্মা সেতু দিয়ে আমরা প্রথম সাহস সঞ্চয় করেছি। আজকে তার সুবাদেই কথা বলছি যে, আমরা ওই দিকেই যাব।

ব্যাংকের কাজ হলো নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা; বেশি বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। লক্ষ্য করবেন যে, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কোনো অর্থায়ন হচ্ছে না, কোনো ব্যাংকও বুঝতে চাইছে না যে, এটি একটি বড় সম্ভাবনাময় খাত। নিচের দিকে অর্থাৎ অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ দরকার। যদিও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি, এখন দরকার রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া।

শেয়ার বিজ: করোনা সংক্রমণের মধ্যেও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো অবস্থানে আছে। এটা ধরে রাখতে করণীয় কী?

পারভেজ তমাল: করোনা সংক্রমণের মধ্যেও দেশের অর্থনীতি এগিয়েছে, এটি আসলে সরকারের প্রচেষ্টার ফসল। করোনায় সারা বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবে সরকারের প্রচেষ্টা ছিল অর্থনীতির চাকা সচল রাখার বিষয়ে।

রপ্তানিতে বিশাল ধস নেমেছে। সেখানে একটা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এখানে সরকার একটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে, প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। নিচের দিকের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। বেশিদিন লকডাউন ছিল না। সরকারের সাহসিকতা আর চ্যালেঞ্জের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সম্মুখযোদ্ধার মতো কাজ করেছে। কভিডের মধ্যেও জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি রয়েছে, এটা আমাদের আরও সাহস জোগাবে এবং ভবিষ্যতে ৮, ৯, ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেটিও অর্জন করা সম্ভব হবে।

শেয়ার বিজ: বৈধ পথে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে প্রবাসীদের জন্য আপনারা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

পারভেজ তমাল: আমাদের প্রায় এক কোটি ১০ লাখ বা তারও বেশি প্রবাসী আছেন। তার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য আর মালয়শিয়াতেই বেশি। সেখানে বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে অনেক রেমিট্যান্স হাউস কাজ করছে। আমরাও রেমিট্যান্স হাউসগুলোর সঙ্গে কাজ করছি। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সভা-সেমিনার করে বোঝাচ্ছি যে, রেমিট্যান্স সরাসরি ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা উচিত। এ কারণে করোনার মধ্যেও রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক ছিল। আবার সরকারের দুই শতাংশ প্রণোদনা প্যাকেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের দরকার হলো অল্প খরচে কিভাবে প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে পারবেন, সেই ব্যবস্থা করা এবং রেমিট্যান্স পাঠানোর পথকে সহজ করে দেয়া। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রথমত যে কাজটা করছি সেটি হলো ই-কেওয়াইসি’র মাধ্যমে প্রবাসীদের অ্যাকাউন্ট করা এবং সচল রাখা।

শেয়ার বিজ: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

পারভেজ তমাল: শেয়ার বিজকেও ধন্যবাদ।