প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

উন্নয়ন টেকসই করতে অর্থপাচার বন্ধ করতে হবে

আবুল কালাম আজাদ: অর্থপাচার (মানি লন্ডারিং) ঠেকাতে দেশে ২০০২ সালে প্রথম মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয়। পরে কয়েক দফা এই আইনের সংশোধন করা হয়। আইন অনুযায়ী, অর্থ বা সম্পত্তি পাচারের অর্থ হচ্ছে দেশের বিদ্যমান আইন লঙ্ঘন করে দেশের বাইরে অর্থ বা সম্পদ পাঠানো কিংবা রক্ষণ করা। আবার দেশের বাইরে এমন অর্থ বা সম্পত্তি, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে, কিন্তু তা আনা হয়নি, তাও মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ। আবার বিদেশ থেকে প্রকৃত পাওনা দেশে না আনা, কিংবা বিদেশে প্রকৃত দেনার অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করা এই আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

আইনে ২৭ ধরনের অপরাধ

২৭ ধরনের অপরাধকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব অপরাধের মধ্য রয়েছেÑদুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে সম্পদ অর্জন, মুদ্রা জাল করা, দলিল-দস্তাবেজ জাল করা, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, অবৈধ মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবসা, চোরাই ও অন্যান্য দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা, অপহরণ, অবৈধভাবে আটক রাখা, খুন ও মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি, নারী ও শিশু পাচার, চোরাকারবারি, দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার, চুরি-ডাকাতি-দস্যুতা-জলদস্যুতা বা বিমানে দস্যুতা।

মানি লন্ডারিং অপরাধের মধ্যে আরও রয়েছে মানব পাচারের মাধ্যমে সম্পদ অর্জন, যৌতুকের অর্থ, চোরাচালান ও শুল্কসংক্রান্ত অপরাধ, করসংক্রান্ত অপরাধ, মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন, ভেজাল বা স্বত্ব লঙ্ঘন করে পণ্য উৎপাদন, পরিবেশগত অপরাধ, যৌন নিপীড়ন, পুঁজিবাজার-সম্পর্কিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশের আগে তথ্য কাজে লাগিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায় এবং সংঘবদ্ধ কোনো অপরাধী দলে অংশ নেয়া।

আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে দুর্নীতি ও ঘুষসংক্রান্ত মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর বাইরে ২৫টি অপরাধ তদন্ত করতে পারবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি ছাড়াও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কাস্টমস, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পরিবেশ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তদন্ত করার ক্ষমতা রাখে।

মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলার বিচার করার এখতিয়ার কেবল বিশেষ জজ আদালতের। মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত উল্লিখিত ২৭ ধরনের অপরাধ করা কিংবা করার চেষ্টা, সহায়তা করা কিংবা ষড়যন্ত্র করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর, সর্বনি¤œ ৩ বছর। আর এভাবে অর্জিত সম্পদের দ্বিগুণ কিংবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা করতে পারবেন আদালত। মানি লন্ডারিং অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করবেন আদালত।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ১০ ধারায় বলা হয়েছে, ছয় মাসের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করবেন তদন্ত কর্মকর্তা। এই আইনের অপরাধ আমলযোগ্য, আপসযোগ্য নয়। একই সঙ্গে এই আইনের অপরাধ অজামিনযোগ্য।

অর্থ পাচার রোধে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, অর্থ পাচার রোধে দুটি প্রক্রিয়া এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য। প্রথমটি প্রতিকারমূলক, অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি অর্থ পাচার ও সংশ্লিষ্ট অপরাধে জড়িত, এ রূপ গ্রহণযোগ্য অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যে দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনের আলোকে পারস্পরিক আইনি সহায়তার মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং পাচারকারীর জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

সব ধরনের অনৈতিক প্রভাব, ভয়-করুণা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে থেকে স্বল্প মেয়াদে আর্থিক সংকট মোকাবিলায় এবং মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে টেকসইভাবে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার উদাহরণ হিসেবে সরকার অবিলম্বে সিআরএসে যোগদানের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেÑএই প্রত্যাশা করতে দোষ নেই। একই সঙ্গে দেখার বিষয়, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকার জাতীয় পর্যায়ে প্রযোজ্য আইনি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করবে কি না।

এই প্রক্রিয়া দুদকসহ বাংলাদেশের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে মোটেই অজানা নয়। সিঙ্গাপুর থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা ও পাচারকারীর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে যদিও পাচারকারীর রাজনৈতিক পরিচয় মূল প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছিল, তারপরও সে ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল, তা শুধু বহাল নয়, বরং বর্তমানে আরও শক্তিশালী ও সহজতর হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনা বা ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থানপুষ্ট প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে ওই অভিজ্ঞতাপ্রসূত প্রক্রিয়া দুদকসহ দেশের অন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কতটুকু কাজে লাগাতে চেয়েছে বা পারবে, তার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাবলিক ডোমেইনে নেই।

দ্বিতীয় পদ্ধতিটি একই সঙ্গে প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক, যার সুযোগ নাগালের মধ্যে হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনও গ্রহণ করেনি। আর তা হচ্ছে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার রোধে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দেশে-বিদেশে সব ধরনের লেনদেনের স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান-প্রদান সহায়ক কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস)।

২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা ওইসিডির উদ্যোগে প্রণীত এবং ২০১৭ সাল থেকে কার্যকর ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দেশে-বিদেশে সব ধরনের লেনদেনের স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান-প্রদান সহায়ক সিআরএসের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিবেশী কোনো কোনো দেশসহ বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশ তাদের স্বদেশি এবং বিদেশি নাগরিকদের সব ধরনের ব্যাংকিং ও আর্থিক লেনদেনের তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবীক্ষণের পাশাপাশি তথ্যের লেনদেনের মাধ্যমে একদিকে দেশে-বিদেশে কর ফাঁকি নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব আদায় এবং অন্যদিকে অর্থ পাচার প্রতিরোধ, চিহ্নিতকরণ, উদ্ধারসহ জবাবদিহি নিশ্চিতের সুযোগ গ্রহণ করছে।

ক্রমবর্ধমান অর্থ পাচার বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ যে গগনচুম্বী, এ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। মনে রাখতে হবে, সুইস ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের একটি গন্তব্য মাত্র। সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশিরা আট হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ বিভিন্ন সুইস ব্যাংকে জমা করেন, যার অংশবিশেষ বৈধ লেনদেনও হতে পারে। এটি বিবেচনায় নিয়ে সুইস ব্যাংকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ যতই হোক, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় অন্য আরও অনেক গন্তব্যে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থসম্পদ প্রতিবছর পাচার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের মতো গন্তব্যের পাশাপাশি ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ এবং তথাকথিত করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত বিশ্বের অনেক অফশোর অঞ্চল বাংলাদেশি অর্থ পাচারের জন্য ক্রমবর্ধমান হারে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে বলে জানা যায়।

একইভাবে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের অর্থ পাচারের বেশিরভাগ সংঘটিত হয় আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে মিসইনভয়েসিং বা চালান জালিয়াতির মাধ্যমে, যার ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক কর ফাঁকি সংঘটিত হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, ২০০৮-১৫ মেয়াদে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বছরে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার (অর্থাৎ ৭১ হাজার কোটি টাকা), যা হালনাগাদ তথ্যপ্রাপ্তি সাপেক্ষে এরই মধ্যে কমপক্ষে যে ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

উল্লিখিত বিশাল মাত্রার অর্থ পাচার প্রতিরোধের পাশাপাশি রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য কার্যকর সিআরএস অবলম্বন করা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য আইনগত ও নৈতিক দায়িত্ব, যার সুফল চলমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফের মতো সংস্থার কাছ থেকে প্রস্তাবিত এককালীন ঋণের তুলনায় শুধু যে বহুগুণে বেশি হবে তা-ই নয়, বরং এর ফলে বার্ষিক ভিত্তিতে সুলভ ও টেকসইভাবে অভাবনীয় হারে কর আদায় বাড়বে এবং অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণের পথ সুগম হবে।

সিআরএসে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর ব্যাংক, আর্থিক ও কর প্রতিষ্ঠান অন্য সদস্য দেশের নাগরিকদের আর্থিক লেনদেনের সব তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট দেশের কর, আর্থিক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিতভাবে সরবরাহ করছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অর্থ পাচারের গন্তব্য দেশগুলো, এমনকি তথাকথিত করস্বর্গ দেশ বা অঞ্চলগুলোও এরই মধ্যে সিআরএসের আওতাভুক্ত হয়েছে এবং তথ্য আদান-প্রদান করছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাংক-গোপনীয়তার জটিলতা, যা সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই অর্থ পাচার রোধে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে উল্লেখিত হয়ে থাকে, তা থেকে মুক্তির উপায় এখন বাংলাদেশের নাগালের মধ্যে।

সব ধরনের অনৈতিক প্রভাব, ভয়-করুণা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে থেকে স্বল্প মেয়াদে আর্থিক সংকট মোকাবিলায় এবং মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে টেকসইভাবে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার উদাহরণ হিসেবে সরকার অবিলম্বে সিআরএসে যোগদানের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেÑএই প্রত্যাশা করতে দোষ নেই। একই সঙ্গে দেখার বিষয়, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকার জাতীয় পর্যায়ে প্রযোজ্য আইনি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করবে কি না।

মুক্ত লেখক