সাজ্জাদ হুসাইন: কয়েক বছরে বাংলাদেশ সরকার বড় বড় অনেক প্রকল্প শুরু করেছে এবং কিছু বাস্তবায়নেও সাফল্য দেখিয়েছে। কিছু প্রকল্প আছে উদ্বোধনের অপেক্ষায়। কিছু প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলছে। এসব বড় বড় প্রকল্পের মধ্যে ঢাকার মেট্রোরেল নির্মাণ অন্যতম। এটি আমাদের সরকারের এবং দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট। এ বছরের শেষ দিকে মেট্রোরেলের একটা অংশ চালু করার কথা শোনা যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে মেট্রোরেল প্রকল্পের নকশায় জটিলতা দেখা গেছে, স্টেশনে প্রবেশ ও প্রস্থানের পয়েন্টগুলো যাত্রীদের জন্য সুবিধাজনক নয় বলা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বলা হচ্ছে নির্মাণ খরচও বাড়বে। এই নির্মাণ খরচ বাড়ার দরুন পদ্মা সেতু থেকেও ব্যয়বহুল প্রকল্পে পরিণত হতে যাচ্ছে মেট্রোরেল প্রকল্প। পদ্মা সেতুতে ব্যয় বাড়তে বাড়তে মোট ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আর মেট্রোরেল প্রকল্পের নতুন সংশোধিত ব্যয়সহ মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। বছরের পর বছর ধরে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ না হতে দেখা এবং খরচ বাড়া বেদনাদায়ক। মেট্রোরেলের অনুমোদন হয়েছে ২০১২ সালে এবং কাজ শুরু হয়েছে ২০১৬ সালে। অনুমোদনের প্রায় ৯ বছর পরে এসে বলা হচ্ছে এটির নকশায় ভুল বা জটিলতা রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, নকশা প্রণয়নের সময় কি এ বিষয়গুলো নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা করা হয়নি? যদি যথেষ্ট গবেষণা করা হয়ে থাকে তাহলে কেন এমনটা হলো? নির্মাণ খরচ কেন এত বাড়ল? এটি কি আমাদের উন্নয়নের স্থায়ী ফেনোমেনা হয়ে গেছে?
বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিগত এক দশকে যেমন আমূল পরিবর্তন হয়েছে, তেমন এই খাতটিকে ঘিরে রয়েছে বিতর্ক। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ব্যয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক উন্নত দেশের নির্মাণ ব্যয়কেও ছাড়িয়ে যায়। এই ব্যয় এতটাই সীমার বাইরে যে, চীন ও ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায় ওইসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চার থেকে আটগুণ পর্যন্ত অধিক খরচ হয়। বর্তমান সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ৮টি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মেট্রোরেলও রয়েছে। এই মেট্রোরেলের সাম্প্রতিক প্রস্তাবিত সময় এবং খরচ যদি বাড়ে তাহলে গুরুত্বপূর্ণ ফাস্ট ট্র্যাক ৮টি প্রকল্পের ৭টি প্রকল্পেরই সময় এবং ব্যয় বাড়বে। বাকি থাকবে শুধু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ কথা সত্য যে, বড় বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের বাইরের অর্থ বা বিভিন্ন এজেন্সির ওপর অনেকটা নির্ভর করতে হয়, তাদের মর্জি বা চাওয়া না চাওয়ার ওপর অনেক সময় দেখা যায় সময় বাড়াতে হচ্ছে। এগুলো তো সবারই জানা, বিশেষ করে যারা কাজগুলো করেন বা প্ল্যানে থাকেন তারা আরও ভালো জানেন। তারা জেনেও কেন সেইভাবে প্ল্যান করেন না? নির্দিষ্ট একটা সময় পরে এসে কেন সময় এবং খরচ বাড়াতে হয়? দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বাড়ানোর বিষয়টি নিয়মে পরিণত হওয়া নিয়ে ইতিপূর্বে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘প্রকল্প যে সময়ে নেবেন, সেই সময়ে শেষ হওয়া উচিত। সময় আরও বাড়িয়ে নিয়ে আসেন, ব্যয়ও আরও বাড়িয়ে নিয়ে আসেন এটা হতে পারে না।’ প্রধানমন্ত্রী নিজে বলা সত্ত্বেও যদি বারবার সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে সেটা খুবই দুঃখজনক এবং হতাশাজনক। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে কোনো পরিবর্তন না আসাটা অগ্রহণযোগ্য।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জবাবদিহির অভাবের কারণেই বারবার প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ বা ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা বা বেসরকারি পরামর্শদাতাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা বা তাদের দোষী সাব্যস্থ করা হয় না বলেই এটির পুনরাবৃত্তি ঘটে। বড় বড় প্রকল্পের সময়ও ব্যয় বৃদ্ধি এক প্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি এড়াতে অবশ্যই এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে এ ধরনের চর্চা বা মনোভাব পরিবর্তন করার বার্তা প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যদি তাদের মধ্যে পরিবর্তন না আসে বা যদি জনগণের কাছে প্রতিশ্রুত প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে এর জন্য তাদের দায়বদ্ধ করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণ জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সরকার এসব প্রকল্প করে থাকে এবং এগুলোর অধিকাংশই করা হয় ঋণ নিয়ে আর ঋণগুলো পরিশোধ করা হয় সাধারণ জনগণের টাকায়। কিন্তু প্রকল্পগুলোর এই সময় বৃদ্ধির ফলে দেশের জনগণ এসব উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে দিনের পর দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই এসব প্রকল্পের সময় এবং ব্যয় বৃদ্ধি হাতে হাত রেখে চলার অভ্যাস থামাতে হবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়