প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

ঋণগ্রহীতা সেজে কর্মকর্তারা তুলে নেন ঋণের টাকা

এনসিসি ব্যাংক

নজরুল ইসলাম: সঞ্চয়ী, বিশেষ সঞ্চয়ী ও এসওডি ঋণ হিসাবের নামে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা হয় অ্যাকাউন্ট। যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব খোলা হয়েছে, তারা জানেও না। এভাবে হিসাব খুলে ২৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ৫১টি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। জালিয়াতিতে গ্রাহকের ভুয়া মেয়াদি আমানত ও বন্ধ হিসাবও কৌশলে ব্যবহার করা হয়েছে। পে-অর্ডারগুলোর অ্যাকাউন্টস পেয়ি বাতিল করে নগদে পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে কর্মকর্তারা পরস্পর যোগসাজশে ব্যাংকের এক কোটি ৬০ লাখ ৮৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। ঘটনাটি ঘটেছে ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এনসিসি) নরসিংদী সদর শাখায়।

এ ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত এনসিসি ব্যাংক নরসিংদী শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক নাসিরুদ্দীন আহম্মদ, সাময়িক বরখাস্ত সাবেক উপব্যবস্থাপক ফরহাদ হোসেন, এক্সিকিউটিভ অফিসার (বর্তমানে মাধবদী শাখায়) জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক কম্পিউটার অপারেটর সাইফুর রহমান ও সাবেক অফিসার (বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ শাখায়) নাজমুল ইসলামের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি মামলা দায়ের করেছে। গতকাল সোমবার দুদকের গাজীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে উপপরিচালক মোজাহার আলী সরদার বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, নাসিরুদ্দীন আহম্মদ, ফরহাদ হোসেন ও কম্পিউটার অপারেটর সাইফুর রহমান বিভিন্ন গ্রাহকের নামে পরিচালিত বিশেষ সঞ্চয়ী হিসাব, তাদের অজ্ঞাতে অন্যান্য গ্রাহকের হিসাব সংযুক্ত করে অথবা ভুয়া মেয়াদি আমানতকে জামানত দেখিয়ে ঋণ হিসাব খোলেন। প্রকৃত ঋণ হিসাব সমন্বয় করার পরও হিসাবটি বন্ধ না করে সচল রেখে ভুয়াভাবে এসওডি ঋণের লিমিট মঞ্জুর দেখান। তারপর মঞ্জুরিপত্র তৈরি, মঞ্জুরিপত্র ছাড়াই নাসিরুদ্দীন আহম্মদ, ফরহাদ হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম ও নাজমুল ইসলাম ২৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ৫১টি পে-অর্ডার ইস্যু করেন। এক কোটি ৬০ লাখ ৮৮ হাজার টাকা আত্মসাতের উদ্দেশে নাসিরুদ্দীন আহম্মদ ও ফরহাদ হোসেন পে-অর্ডারগুলো অ্যাকাউন্ট পেয়ি বাতিল করে নগদে পরিশোধের জন্য ব্যবস্থা করেন। পরে কম্পিউটার অপারেটর সাইফুর রহমানের কাছে পাঠান। সাইফুর রহমান ও নাজমুল ইসলাম পে-অর্ডারগুলোর সই যাচাই করে নিজেরা স্বাক্ষর দিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থাপক নাসিরুদ্দীন আহম্মদ, উপব্যবস্থাপক ফরহাদ হোসেন ও এক্সিকিউটিভ অফিসার জাহাঙ্গীর আলমের কাছে সেগুলো নগদায়নের জন্য উপস্থাপন করেন। তারা সেগুলো নগদে পরিশোধের জন্য পাস করে কম্পিউটার অপারেটর সাইফুর রহমানের কাছে পাঠান। সাইফুর রহমান পে-অর্ডারের অপর পৃষ্ঠায় নিজেই বিভিন্ন ব্যক্তির স্বাক্ষর জাল করে ক্যাশ থেকে নগদে এক কোটি ৬০ লাখ ৮৮ হাজার টাকা উত্তোলন করে পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাৎ করেন। ২০১৭-২০১৮ সাল সময়ে এসব ঘটনা ঘটেছে।

সঞ্জিত কুমারের নামে দুই লাখ টাকার একটি ভুয়া মেয়াদি আমানত হিসাবের বিপরীতে এসওডি ঋণ হিসাব খোলা হয়। পরে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা ঋণ মঞ্জুর দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। রাশেদা ইসলামের নামে বিশেষ সঞ্চয়ী হিসাবে ৯ লাখ ৭৯ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। জয়নব বেগমের নামে কোনো ধরনের মেয়াদি হিসাব না থাকা সত্ত্বেও মঞ্জুরিপত্র ছাড়াই একটি এসওডি ঋণ হিসাব খোলা হয়, সেখানে পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকার লিমিট দেখিয়ে আকাশ সাহার নামে তিন লাখ ৫০ হাজার ও বীণা সাহার নামে এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। জয়নব বেগমের নামে আরেকটি এসওডি ঋণ হিসাব খুলে আট লাখ টাকার লিমিট দেখিয়ে কমল সাহার নামে একবার চার লাখ ৯০ হাজার, আরেকবার তিন লাখ টাকার পে-অর্ডার তৈরি করে অ্যাকাউন্ট পেয়ি বাতিল করে নগদ উত্তোলনসহ মোট ১২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

ডা. কালায়ন কুমার বিশ্বাসের নামে সঞ্চয়ী হিসাব খুলে লিয়েন রেখে ভুয়া এসওডি হিসাব খোলা হয়। তিন লাখ ৬০ হাজার টাকার ঋণ মঞ্জুর দেখিয়ে কালায়ন বিশ্বাসের নামে তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা পে-অর্ডার ইস্যু করে অ্যাকাউন্ট পেয়ি বাতিল করে নগদে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।

সাজেদা তাসনিমের নামে পাঁচ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর দেখিয়ে সুবাস পালের নামে চার লাখ ৯৫ হাজার ও রকিবুল হোসেনের নামে ৭৫ হাজার টাকার পে-অর্ডারের অ্যাকাউন্ট পেয়ি বাতিল করে পে-অর্ডার দুটি পাস করে নগদে উত্তোলন করে পাঁচ লাখ ৭০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। রিপন সূত্রধরের হিসাবের বিপরীতে সাজেদা তাসনিমের নামে ৮০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

অদিতি রাণী সাহার নামে বিশেষ সঞ্চয়ী হিসাবে ছয় লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর দেখিয়ে সবিতা রাণী সাহার নামে চার লাখ, কবিতা রায়ের নামে এক লাখ ৫৫ হাজারসহ দুটি পে-অর্ডারের অ্যাকাউন্ট পেয়ি বাতিল করে নগদে উত্তোলন করে পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

নাসির মিয়ার নামে সাত লাখ ৯৮ হাজার টাকার ঋণ মঞ্জুর দেখিয়ে সবিতা রাণী সাহার নামে দুই লাখ ১৫ হাজার, কমল সাহার নামে তিন লাখ ৯৫ হাজার, সবিতা রাণী সাহার নামে এক লাখ ৮৫ হাজার; নাসির মিয়ার নামে আরেকটি ঋণ হিসাবে ১৪ লাখ ৯০ হাজার টাকার ঋণ মঞ্জুর দেখিয়ে সঞ্জিত কুমারের নামে চারটি পে-অর্ডারে ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নগদে তুলে আত্মসাৎ করা হয়।

মেসার্স আলিফ ইন্টারন্যাশনালের নামে একটি এসওডি হিসাব খুলে গ্রাহকের অজান্তে ১৫ লাখ টাকার লিমিট দেখিয়ে কমল চন্দ্রের নামে পাঁচ লাখ ১০ হাজার টাকা পে-অর্ডারের অ্যাকাউন্ট পেয়ি বাতিল করে ক্যাশ কাউন্টার থেকে নগদে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। মেসার্স মাসুম অ্যান্ড ব্রাদার্সের নামে এসওডি হিসাব খুলে ১৫ লাখ টাকার লিমিট দেখানো হয়। গ্রাহকের অজান্তে দুটি পে-অর্ডারে বেলাবো এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলীর বিপরীতে তিন লাখ ৪০ হাজার ও মিয়া রানী দাসের নামে দুই লাখ ১৫ হাজার টাকার পে-অর্ডারে মোট পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। মেসার্স সূচী এন্টারপ্রাইজের নামে এসওডি হিসাব খুলে গ্রাহকের অজান্তে ১৫ লাখ টাকার লিমিট দেখিয়ে বিজয় কুমার সাহার নামে তিন লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। মেসার্স কামাল অ্যান্ড ব্রাদার্স ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের নামে দুই লাখ ৬৯ হাজার টাকার পে-অর্ডার ইস্যু ও অ্যাকাউন্ট পেয়ি বাতিল এবং নগদ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। এভাবে ২৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া হিসাব খুলে ওইসব টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

দুদকের মামলার প্রসঙ্গে এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ মামদুদুর রশিদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অডিট রিপোর্ট দেখে বলতে হবে। অডিট টিমের সঙ্গে কথা বলি। কারণ ঘটনার সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না।’

উল্লেখ্য, এনসিসি ব্যাংকের একই ধরনের অপরাধের পৃথক একটি অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান সেটির অনুসন্ধান কর্মকর্তা।