মেহেদী হাসান নাঈম: ময়লা কাগজ, পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, পচা-মরা পশু-পাখিসহ শহরের সব ধরনের ময়লা-বর্জ্য ভাসছে। এগুলো পচে গিয়ে যে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, তা হয়তো শহরবাসীর নাক অবধি পৌঁছায় না। পানির মতো দেখতে কালো যেটুকু চোখে পড়ে তা মূলত টয়লেট থেকে আসা শৌচকার্যে সৃষ্ট তরল বর্জ্য, অথবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য পদার্থ। টিস্যু, হাট-বাজারের পচা সবজি, এমনকি শিশুদের ব্যবহƒত বেবি ডায়াপার পর্যন্ত স্থান পেয়েছে এখানে। কোনো স্মার্ট ডাস্টবিন নয়। এটি একসময়কার খরস্রোতা করতোয়া নদী। যেসব ময়লা-বর্জ্যরে জায়গা ডাস্টবিনেও হয় না, সেসব ক্ষেত্রে ভদ্র মহোদয়রা খুব সহজেই করতোয়ায় জায়গা করে নেন। দেশের উত্তর জনপদের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের প্রশ্নে শুরুতেই আসবে করতোয়া নদীর নাম, ?যার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল সোনালি ইতিহাস। হাজার বছরের প্রাচীন গ্রন্থ মহাভারতে করতোয়ার কথা উল্লেখ আছে। করতোয়া নদী ছিল গঙ্গা নদীর তিনগুণ। ১১১৫ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গদেশ অভিযানের সময় রচিত একটি গ্রন্থে করতোয়া যে গঙ্গার চেয়ে কতগুণ বড় ছিল, তার বর্ণনা দেয়া আছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে করতোয়া নদী পবিত্র। মহাভারত অনুযায়ী তিন দিন পর করতোয়া দর্শন হচ্ছে অশ্মমেধা, অর্থাৎ ঘোড়াকে বলি দেয়ার সমান। পুরাণে আছে, দেবতা শিব-পার্বতীর বিয়ের সময় শিবের কররেখা থেকে এই নদীর জলধারার উৎপত্তি। করতোয়া নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের জলপাইগুড়ি জেলার বৈকণ্ঠপুরের অরণ্যগর্ভে। ভুটানের সীমান্ত বেয়ে দার্জিলিং জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর অঞ্চল ছুঁয়ে করতোয়ার জলধারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এঁকেবেঁকে চলা নদীর এই সর্পিল গতি মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কবলে পড়েছে অনেক আগেই। নদী কোথাও শীর্ণকায় এক খাল, কোথাও সামান্য পানি, তাও দূষণে কালো হয়ে গেছে। কোথাও নদীর মধ্যে তৈরি করা হয়েছে চাষের ভূমি। কোথাও নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবকাঠামো। নদীর কিছুটা ভিতরে ও নদীর মুখে নির্মিত হয়েছে কংক্রিটের বহুতল ভবন। নদীর ভিতরে নগরীর বর্জ্য আবর্জনা ফেলে বড় ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। পচা গন্ধে এই পথ ধরে হাঁটা যায় না। করতোয়া নদীর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বগুড়া অংশে। নগরীর রেলব্রিজ-সংলগ্ন নদীভূমি দেখে মনে হবে বর্জ্য ফেলার ভাগাড়। ময়লা, দুর্গন্ধ, দখল ও দূষণে করতোয়া এখন সরু খাল।
একসময় বিশাল জলরাশির ঢেউ আছড়ে পড়ত নদীর দুই তীরে। নির্মল স্বচ্ছ পানিতে স্রোতের গতি, কল-কল শব্দ মানুষকে কাছে টানত। দুরন্ত কিশোরের দল ঝাঁপিয়ে পড়ত নদীর বুকে। স্রোতে গা ভাসিয়ে মিতালি করতোয়া নদীর সঙ্গে। হাজার জাতের মাছ ধরার উৎসব হতো। মাঝি-মাল্লারা ভাটিয়ালি ও জারি-সারি গান গেয়ে নৌকা বাইত। প্রতি বছর বর্ষার শেষে নৌকা বাইচের আয়োজন হতো। চলত নৌকা ও স্টিমার। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই পুণ্ড্রনগর গড়ে ওঠে করতোয়ার কোলঘেঁষেই। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সওদাবাহী শত শত নৌকা ভিড়ত পুণ্ড্রনগরের তীরে। সুদূর খুলনা থেকে নারকেল ও ইলিশ আসত। এখান থেকে যেত কাঁচা তরকারিসহ অনেক কৃষিপণ্য। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচার-প্রসার ঘটে এই নদীকে কেন্দ্র করেই।
দীর্ঘদিনে মরে যাওয়া নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে এক যুগ আগে প্রকল্প নেয়া হয়। নানা জটিলতার কারণে সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে করতোয়া এখন দখলদারদের অন্যতম লক্ষ্য। নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে ব্যক্তিমালিকানায় প্রতিষ্ঠিত শিল্প, আবাসিক ভবন, হাসপাতাল ও মার্কেট। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র অনুযায়ী, ২০০২ সালে করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল নদীর নাব্য বৃদ্ধি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, নিচু এলাকাকে বন্যা থেকে রক্ষা করা। এ ছাড়া নদীর দুই তীর বাঁধাই করার মাধ্যমে জলপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখা এবং শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। পাউবো, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও পৌরসভা যৌথভাবে এ প্রকল্প হাতে নেয়। এ জন্য ১২৫ কোটি টাকার একটি খসড়া প্রকল্প (পিপি) সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরে আর সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
করতোয়ার বুকে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে কবিতা তো দূরের কথা, স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে ভুল করেও এই নদীর পাশে গেলে খানিক বাদে অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। করতোয়া নিয়ে প্রায়ই সংবাদ প্রচার হয়। পত্রপত্রিকায় লেখাও হয়। হয় না শুধু করতোয়ার কোনো পরিবর্তন। নদী আমাদের দেশের হƒৎপিণ্ডের ধমনির মতো। করতোয়া বাঁচলে বাঁচবে বগুড়া, নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ। ঐতিহাসিক করতোয়া নদীতে প্রাণ ফিরে আসুক, সবার ভেতর পরিবেশগত সচেতনতা বৃদ্ধি হোক, দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে না যাক করতোয়া নদীর অস্তিত্বÑএই হোক প্রত্যাশা।
শিক্ষার্থী
সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া