সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: ভোজ্যতেলের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্স দেড় দশক আগে ভোজ্যতেলের বাজারের দেশের মোট আমদানির ১৮ শতাংশ তেল এককভাবে আমদানি করত। প্রতিষ্ঠানটি ছিল দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ ভোজ্যতেল আমদানিকারক। এখন ভোজ্যতেলের বাজারের এই প্রতিষ্ঠানটির অবস্থানই নেই। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, ঋণ ব্যবহারের অদক্ষতায় ২০১০ ও ২০১১ সালের দিকে খেলাপি তালিকায় নাম আসে। এখন দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির মধ্যে শীর্ষে ইলিয়াছ ব্রাদার্সের। অর্থাৎ এক দশকের বেশি সময় ধরে খেলাপির বৃত্তে এমইবি গ্রুপ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, চট্টগ্রামের বাকলিয়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইলিয়াস ১৯৪৬ সালে ব্যবসা শুরু করেন। মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্স স্বাধীনতার আগে দেশের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় আসে। আর স্বাধীনতা-পরবর্তী ইউনিলিভারের প্রধান পরিবেশক হয়ে ব্যবসা করে প্রায় তিন যুগ। এরপর ইউনিলিভারের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে বিভিন্ন শিল্প গড়ে তোলে ইলিয়াছ ব্রাদার্স। এর মধ্যে গ্রুপটি দাদা সয়াবিন তেল, ড্রিংকিং ওয়াটার, গ্লাস, নিটিংসহ একাধিক ব্যবসা শুরু করে। সেই সময়ে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান ছিল চট্টগ্রামের মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্স (এমইবি)। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৬ ও ২০০৭ সালে ভোজ্যতেলের বাজারের দেশের মোট আমদানির ১৮ শতাংশ তেল এককভাবে আমদানি করে এমইবি গ্রুপের দাদা ব্র্যান্ডের। মূলত ২০০৬ সালের পর অনিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ ও পারিবারিক দ্বন্দ্বে ব্যবসায়িকভাবে ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকে। আর ২০০৯/১০ সালে ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে একের পর এক তা খেলাপি হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৬৫ কোটি টাকার বেশি। যার পুরোটাই খেলাপি ঋণ। সম্প্রতি সংসদে প্রকাশিত দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকায় চার নম্বর অবস্থানে ইলিয়াছ ব্রাদার্সর। প্রথম দিকে মোহাম্মদ ইলিয়াছ তার ভাইকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে গ্রুপটির মালিকানায় আসেন দুই ভাইয়ের সন্তান। তাদের সন্তানদের মধ্যে ব্যবসায়িক মনোভাব ছিল কম। এছাড়া সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে গ্রুপটির কর্ণধার দুই ভাইয়ের সন্তানরা আলাদা হয়ে পড়েন। ফলে কেউ আর দায়িত্ব নিতে আগ্রহী ছিল না।
ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে বড় গ্রাহকদের ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। শর্ত হিসেবে ঋণের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার কম হলে ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিতে হতো ২ শতাংশ। ১ হাজার কোটি টাকা ও তার বেশি অঙ্কের ঋণের জন্য এককালীন জমার হার ছিল ১ শতাংশ। কিন্তু পুঁজি সংকটে ইলিয়াছ ব্রাদার্স এ সুযোগ নিতে পারেনি। ফলে ইলিয়াছ ব্রাদার্স ১৫টি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া ৯৬৫ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৮০ কোটি টাকা। এছাড়া এবি ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ৬১ কোটি ৯৯ লাখ, ব্যাংক এশিয়ার ৩৬ কোটি ৮৩ লাখ, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৭১ কোটি ৮০ লাখ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৪২ কোটি ৭০ লাখ, ওয়ান ব্যাংকের ২৮ কোটি ৫৪ লাখ, পূবালী ব্যাংকের ৬ কোটি ১৯ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২২ কোটি ৪৩ লাখ ও দ্য সিটি ব্যাংকের ৫৬ কোটি টাকাসহ এনসিসি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল, ব্যাংক এশিয়া, ওয়ান ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি পাওনা রয়েছে।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১০ সালের পর চট্টগ্রামের ভোগ্যপণ্য ও জাহাজ ভাঙা ব্যবসায় অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগস্ত হয়। কিন্তু তারা ভুল সিদ্ধান্ত ভোগ্যপণ্য ও জাহাজ কাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। আবার এক খাতের টাকা অন্য খাতে বিনিয়োগ করেছিল। এছাড়া ব্যাংকগুলো না বুঝে কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করছে। সবমিলিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এগিয়ে আসার কারণে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেয়া হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকের দিক বিবেচনা করে খেলাপি গ্রাহকদের যে সুবিধা দেয়া হয়েছে, তার সদ্ব্যবহার করা দরকার ছিল। এমইবিসহ বড় খেলাপি এক দশকের বেশি সময় ধরে খেলাপি তালিকায় রয়ে গেছে।
সম্প্রতি আলাপকালে ইলিয়াছ ব্রাদার্সের পরিচালক শোয়েব রিয়াদ ঋণ পরিশোধ ও ব্যবসায়িক পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় বড় অঙ্কের লোকসানের কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে ইলিয়াছ ব্রাদার্স। এর মাঝেও বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছে। আসল ব্যবসা রানিং না থাকলে বড় কিছু করা সম্ভব না।