প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

এক লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আটকা

অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ১৮৯ মামলা

রোহান রাজিব: অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে দেশের ব্যাংকগুলোর এক লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ অনাদায়ী রয়েছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এসব আদালতে মামলার নিষ্পত্তি হলেও খেলাপি ঋণ আদায় কম হচ্ছে। মূলত অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি ও চাপে পড়ে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া ও ভুয়া দলিলপত্রে ঋণ দেয়ার কারণে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরও টাকা আদায় হচ্ছে না।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ব্যাংকগুলো আদায়ের কথা মাথায় না রেখে অনেক সময় ঋণ দেয়। এক্ষেত্রে মালিকপক্ষ বা রাজনৈতিক চাপ থাকে। এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত থাকে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে জাল কাগজের বিপরীতে যোগসাজশ করে ঋণ দেয়া হয়, কিংবা বন্ধকি সম্পত্তির প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দর দেখিয়ে ঋণ দেয়া হয়। জাল কাগজের ফলে অনেক সময় সম্পদ বিক্রির ঝামেলাও থাকে। তাই মামলা নিষ্পত্তি হলেও আদায় বাড়ে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ১৮৯টি বিচারাধীন মামলার বিপরীতে আটকে আছে এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। বিচারাধীন এসব মামলায় আদায় হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ২০২১ সাল শেষে অর্থঋণ আদালতে ৬৮ হাজার ২৭১টি বিচারাধীন মামলার বিপরীতে আটকে ছিল এক লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। বিচারাধীন এসব মামলায় ওই সময় আদায় হয়েছে মাত্র চার হাজার ৬১০ কোটি টাকা।

আলোচ্য সময়ে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৫ হাজার ৬০৪টি। এতে পাওনা অর্থের পরিমাণ ৭১ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর অর্থঋণ আদালতে পাঁচ হাজার ২৮টি মামলা বিপরীতে দুই হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা পাওনা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৪১ হাজার ১৫৩টি মামলায় ৮৮ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা পাওনা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর আট হাজার ৬০২টি মামলার বিপরীতে তিন হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা পাওনা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবী মো. রুহুল আমিন ভূঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, অর্থঋণ আদালতের পুরো বিচার প্রক্রিয়াটাই দীর্ঘমেয়াদি। মামলা নিষ্পত্তিতে সময় লাগার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে যে কারণগুলো সব মামলার ক্ষেত্রে বলা যায়, সেটা হচ্ছে সমন জারিতে অনেক সময় লাগে। বিবাদী পক্ষ নি¤œ আদালত থেকে মামলা উচ্চ আদালতে নিয়ে যায়। উচ্চ আদালতে মামলাজট থাকায় শুনানিতে দেরি হয়। আবার অনেকে রিট মামলা করেন। রিটের চূড়ান্ত শুনানিতেও অনেক সময় লেগে যায়।

তিনি আরও বলেন, অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হলেও টাকা না আদায় হওয়ার কারণ হলোÑবড় গ্রাহকদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই না করা। এতে ঋণের ক্ষেত্রে যেসব জামানত কাগজপত্রে দেখানো হয়, তা বাস্তবে নেই। ফলে মামলা নিষ্পত্তি হলেও ব্যাংক টাকা ঋণ আদায় করতে পারে না। আর এসবই হচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। এছাড়া মালিক পক্ষ ঋণ নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। তখন কর্মকর্তারা বাধ্য হয়ে ঋণ দিয়ে দেয়। ব্যাংক খাতের জন্য এটা বড় সমস্যা।

তথ্য অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালত আইনে মোটমামলা দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ২২ হাজার ৩৪৮টি। দুই লাখ ৪৯ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা আদায়ে এসব মামলা করে ব্যাংক। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার ১৫৯টি মামলা। এসব মামলায় ৮২ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা দাবির বিপরীতে ব্যাংকগুলো পেয়েছে মাত্র ২১ হাজার ৮২ কোটি টাকা।

২০২১ সাল শেষে অর্থঋণ আদালত আইনে মোট মামলা ছিল দুই লাখ সাত হাজার ৮৯৬টি। দুই লাখ ১৩ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা আদায়ে এসব মামলা করে ব্যাংক। ওই সময় পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছিল এক লাখ ৩৯ হাজার ৬২৫টি মামলা। এসব মামলায় ৭০ হাজার ৪১ কোটি টাকা দাবির বিপরীতে ব্যাংকগুলো পেয়েছে মাত্র ১৯ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা বলছেন, অর্থঋণ আদালতে মামলায় যেসব টাকা আটকে আছে সেগুলো মূলত জনগণের টাকা। এসব মামলা শিগগির নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। তা না হলে ব্যাংকগুলো মন্দ ঋণের বোঝা বড় হচ্ছে। মামলা পরিচালন বাবদ খরচ বাড়ছে।

তাদের দাবি, ঢাকায় কমপক্ষে আরও দুটি এবং চট্টগ্রামে একটি অর্থঋণ আদালত স্থাপন করা হোক। পাশাপাশি যেসব বিভাগীয় শহর ও জেলায় সুনির্দিষ্ট অর্থঋণ আদালত নেই, সেখানে ন্যূনতম একটি করে আদালত স্থাপন করা জরুরি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ঋণ আদায়ের জন্য মামলা করা হলেও অর্থঋণ আদালতে বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যেই সময়ক্ষেপণের সুযোগ রয়েছে। এ আদালতে রায় হওয়ার পরও খেলাপি গ্রাহকরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। বছরের পর বছর পার হলেও সেই প্রক্রিয়া শেষ হয় না। এজন্য দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, পর্যাপ্ত সংখ্যক আদালত ও বিচারক সংকটের কারণে মামলাগুলো দীর্ঘদিন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকে। আবার আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেন অনেক ঋণখেলাপি। ফলে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয় ব্যাংকের, পাশাপাশি নষ্ট হয় মূল্যবান সময়।

তিনি আরও বলেন, খেলাপিদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের আইনি কাঠামো অন্যান্য দেশের মতো শক্তিশালী নয়, যা আছে সেই আইনি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রভাবশালী শক্তি সক্রিয়।

খেলাপি ঋণ আসলে কত

ঋণ পুনঃতফশিল, পুনর্গঠনসহ নানা ছাড়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার অনেক গ্রাহকের আবেদনে উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি না দেখানোর ওপর আদেশ দেয়া হচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আসলে কত, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকায়। ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণস্থিতির যা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর বাইরে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৩ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। ব্যাংকাররা বলছেন, দেশে নথিপত্রে খেলাপি ঋণ যতই দেখানো হোক না কেন, প্রকৃত চিত্র তার চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি।