পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সম্প্রতি চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হালনাগাদ চিত্র প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, তিনটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কোনো টাকাই খরচ করতে পারেনি। তাদের মোট ২০টি প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। এই বিপুল বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কোনো টাকা খরচ করতে পারেননি এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা। এই তিন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হলো স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংসদবিষয়ক সচিবালয়।
দক্ষতার অভাবে কিংবা সুশাসন ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকায় বরাবরই বাজেট বাস্তবায়নের হার ৮০-৮৫ শতাংশের ঘরে। এ হার বৃদ্ধিতে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ ছিল না, এখনও নেই।
দেশের জাতীয় বাজেট বাস্তবায়ন একই জায়গায় আটকে আছে। প্রতি অর্থবছরেই বিশাল আকারের বাজেট দেয়া হয়। ৯ মাস শেষে একবার সংশোধন করা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাস্তবায়নের হার আরও কম। বছর বছর ধরে ঘোষিত বাজেটের চেয়ে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা কম ব্যয় হচ্ছে। অর্থাৎ বাজেটের অর্থ ব্যয় করতে পারছে না সরকার।
উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে সমীক্ষা না করা, যোগ্যতম সরকারি কর্মচারীকে যথাযথ পদে নিয়োগ না দেয়া, সরকারি কর্মচারীদের অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি করা এবং বাস্তবতাবিবর্জিত উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের প্রাক্কলন—এসব বিষয়কে বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বাজেট বাস্তবায়নের অদক্ষতার কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতও কম বরাদ্দ পাচ্ছে, ফলে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যদিও অবকাঠামো নির্মাণে ঠিকই দেদার অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, আর ব্যয় হচ্ছে অনুন্নয়ন খাতের প্রায় সব বরাদ্দ।
আমরা মনে করি, আইএমইডির সুপারিশ উপেক্ষা করার এডিপি বাস্তবায়িত হয় না। পরবর্তী সময় প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্রও উঠে আসে।
বিশ্লেষকরা বলেন, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব—মূলত এ দুই কারণে বাজেটের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলো অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে যতটুকু বাস্তবায়িত হয়, পরের তিন মাসেই হয় তার সমান। এতে কয়েকভাবে ক্ষতির শিকার হয় দেশ। একদিকে কাজের মান ঠিক থাকে না, অন্যদিকে খরচ বেড়ে যায়।
বাজেট বাস্তবায়নের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা হয় না বললেই চলে। আর দুঃখজনকভাবে নীতিনির্ধারক বিশেষ করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনগুলো সর্বসাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত করা হয় না।
বাজেট বাস্তবায়নে ব্যর্থতা নিয়ে ব্যতিক্রম ছাড়া ভালো কোনো গবেষণা নেই দেশে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘সরকারি খরচ ও আর্থিক জবাবদিহি (পিইএফএ) মূল্যায়ন ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস্তবায়নের প্রধান দুর্বলতার সঙ্গে জড়িত মূলত বাজেট প্রস্তুতি, জবাবদিহিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাটি আরও বলেছে, সরকারের অ-আর্থিক সম্পদের তথ্য পুরোপুরিভাবে তুলে ধরা হয় না। এ ছাড়া বাস্তবায়ন পর্যায়ে যথাযথ নিরীক্ষা হয় না, যা করা হয় তাও আবার ঝুঁকিভিত্তিক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে হয় না। যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয় না রাজস্ব সংগ্রহের তথ্যও।
সবাই জানেন, বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার মূল কারণ এডিপি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন না হওয়া; আছে অপচয়, ব্যয় করার সক্ষমতার অভাব, অনভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ, অর্থের সংকট ইত্যাদি। বাস্তবায়নে গতি আনতে বছর দশেক আগে ‘পিডি পুল’ করা হয়েছিল। সম্ভবত সেটি আর কার্যকর নয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করতে এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ তৈরি, কর্মসংস্থান তৈরি ও আয় বৃদ্ধির জন্য অন্যতম অনুঘটক হচ্ছে এডিপির বাস্তবায়ন। তাই এডিপির বাস্তবায়নে গতি আনতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post