নিয়াজ মাহমুদ: ঋণপত্র (এলসি) ছাড়াই কাঁচামাল আমদানির সুযোগ পাচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ‘এমজেএল (মবিল-যমুনা লুব্রিক্যান্টস) বাংলাদেশ লিমিটেড’। আমদানি ব্যয় কমাতে কোম্পানিটি বারবার এ অনুরোধ জানিয়ে আসছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে আধাসরকারিপত্র (ডিও) দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিলে এমজেএল বাড়তি সুবিধা পাবে। বাড়বে কোম্পানিটির মুনাফা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, টেলিফোনিক ট্রান্সফারের মাধ্যমে ৬০ দিনের মধ্যে বিলম্বিত অর্থ পরিশোধের (এলসি খোলা ছাড়া) শর্তে এক্সন-মবিল এশিয়া প্যাসিফিক পিটিই লিমিটেড এমজেএল’কে লুব্রিক্যান্টের কাঁচামাল সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের আমদানিকারককে কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের সুবিধা প্রদানের ঘটনা এটাই প্রথম বলে দাবি কোম্পানিটির।
গত ৪ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বরাবর পাঠানো বাণিজ্যমন্ত্রীর ডিও’তে উল্লেখ করা হয়, আধুনিক ক্রসবর্ডার ব্যবস্থায় ‘ওপেন অ্যাকাউন্ট’ একটি স্বীকৃত ও প্রচলিত প্রক্রিয়া। এর ফলে এলসি ডকুমেন্টেশন সহজ হয়। আমদানিকারক ও রফতানিকারকের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে আমদানি মূল্য পরিশোধিত হয়। সময় ও খরচ কমার ফলে পণ্য ব্যবহারকারীরা উপকৃত হন। এমজেএল’কে এক্সন-মবিল এশিয়া প্যাসিফিকের দেওয়া সুযোগ কাজে লাগাতে পরীক্ষামূলক এলসি ছাড়া লুব্রিক্যান্ট আমদানির অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।
পরে পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে এ সুবিধা এক বছর মেয়াদের অধিক বৃদ্ধি বা বাতিল করা যেতে পারে বলে চিঠিতে উল্লেখ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় এমজেএল বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজম জে চৌধুরীর সঙ্গে। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে এ সুবিধা পেলে কোম্পানির আয় আরও বাড়বে বলে উল্লেখ করে শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন সরকারের কাছে আমরা এ দাবি জানিয়ে আসছিলাম। আমরা সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, এর ফলে কোম্পানির পাশাপাশি দেশও উপকৃত হবে। খরচের পাশাপাশি কাঁচামাল আমদানিতে সময় কম ব্যয় হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক্সন-মবিল এশিয়া প্যাসিফিক তাদের সাবসিডিয়ারি ছাড়া সাধারণত এলসি ছাড়া কাঁচামাল অন্য দেশে সরবরাহ করে
না। আমরা সাবসিডিয়ারি না হয়েও এ সুবিধা পাচ্ছি। এখন সরকার সহযোগিতা করলে আমরা এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারব। তখন আমাদের আমদানি ব্যয় অনেকটাই কমে আসবে।’ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হওয়ার সুবাদে এর সুফল সাধারণ বিনিয়োগকারীও পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) সভাপতি আজম জে চৌধুরী।
এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানি মবিল যমুনার তিন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটিই লোকসানে রয়েছে। অন্য প্রতিষ্ঠানটির কর-পরবর্তী মুনাফাও কমছে। তাই সহযোগী তিন প্রতিষ্ঠানের দায় বইতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। মবিল যমুনার নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে মিলেছে এমন তথ্য।
২০১১ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এমজেএল বাংলাদেশের মোট শেয়ারের ৭১ দশমিক ৫৩ শতাংশ রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সাবসিডিয়ারি যমুনা অয়েল কোম্পানির ১৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে কোম্পানিটির দশমিক ৮৭ শতাংশ। বাকি ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ওমেরা সিলিন্ডারস, ওমেরা পেট্রোলিয়াম ও এমজেএল এ তিনটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ওমেরা সিলিন্ডারস লিমিটেডের শতভাগ শেয়ারের মালিক মবিল যমুনা। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ মাসে ৪৯ কোটি ৪৭ লাখ ৮৭ হাজার টাকা আয় করেছে ওমেরা সিলিন্ডারস। আয়ের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় ওই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালন লোকসান হয়েছে দুই কোটি ৬৯ লাখ টাকা। কর প্রদানের পর লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। তবে এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির কর-পরবর্তী লোকসান প্রায় অর্ধেক বা প্রায় তিন কোটি টাকা কমেছে।
অপর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ওমেরা পেট্রোলিয়ামের ৬৮ দশমিক পাঁচ শতাংশ শেয়ারের মালিক মবিল যমুনা। বাকি শেয়ার রয়েছে নেদারল্যান্ডসের প্রতিষ্ঠান বিবি এনার্জি (এশিয়া) পিটিই লিমিটেডের হাতে। যৌথ মালিকানার ওই প্রতিষ্ঠানটিও ধুঁকছে। ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সর্বশেষ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা বাড়লেও লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ওই অর্থবছরে ৩৪ কোটি ১১ লাখ টাকা পরিচালন মুনাফা করলেও শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা কর-পরবর্তী লোকসানের মুখে পড়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ সময়ে ওমেরা পেট্রোলিয়ামের লোকসান প্রায় পৌনে নয় কোটি টাকা বেড়েছে।
তিন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে আছে মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠান য়াং কেয়ুন থারের (একেটি) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এমজেএল অ্যান্ড একেটি পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ৫১ ভাগ শেয়ারের মালিক মবিল যমুনা। মিয়ানমারের ক্রমবর্ধমান বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই ওই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত ১৮ মাসে প্রতিষ্ঠানটির আয় প্রায় এক কোটি ৯১ লাখ টাকা বেড়েছে। তবে আয় বাড়লেও মুনাফা বাড়েনি, উল্টো প্রায় ৩৬ লাখ টাকা কমেছে। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কর-পরবর্তী মুনাফা এক কোটি এক লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
জুন ২০১৭ সমাপ্ত অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের নগদ ৪৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেয় মবিল যমুনা আর এমজেএল। এর আগের অর্থবছরে ৬০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয়। গত এক বছরে মবিল যমুনার শেয়ারদর সর্বনি¤œ ৮৩ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৩৪ টাকায় পর্যন্ত ওঠানামা করেছে।