এম এ খালেক: গ্রামীণ অর্থনীতিতে এখন একধরনের রূপান্তর প্রক্রিয়া চলছে। এ প্রক্রিয়ার আওতায় গ্রামীণ অর্থনীতি ক্রমেই কৃষিনির্ভরতা কাটিয়ে শিল্পকাঠামোর ওপর দাঁড়াচ্ছে। এতে সহায়তার জন্য সরকার বিভিন্ন স্থানে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে ১০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ উদ্বোধন করেছেন। অনেকটা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের আদলে এ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো গড়ে তোলা হবে। এখানে কার্যকর ওয়ান স্টপ সার্ভিসের ব্যবস্থা থাকবে। অর্থাৎ বিনিয়োগের জন্য যে সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, তা একই সঙ্গে এখানে পাওয়া যাবে। চাওয়ামাত্র গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি সংযোগ দেওয়া হবে। কোনো সেবা পেতে এখানে হয়রানির শিকার হতে হবে না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত উপযোগী একটি গন্তব্য হলেও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর সেবা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় মূলত এখানে বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় হচ্ছে না। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের একই স্থান থেকে সব ধরনের সেবা দেবে। ফলে বিনিয়োগ কার্যক্রমে ঈপ্সিত মাত্রায় গতিশীলতা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ধরনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের উদ্যোগ বাংলাদেশে নতুন হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের মতো একটি সমস্যাসঙ্কুল দেশের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল অত্যন্ত কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হবে। তারা বলছেন, আরও আগেই এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। আশার কথা, দেরিতে হলেও সরকার এসইজেড স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, প্রস্তাবিত ১০০টি এসইজেড গঠিত হলে তা বাংলাদেশের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখবে। সরকার চেষ্টা করছে কত দ্রুত এ অঞ্চলগুলো বাস্তবায়ন করা যায়। একশ এসইজেড বাস্তবায়িত হলে রফতানি আয় প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পাবে। এতে প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে, যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি। এসইজেড স্থাপনের ক্ষেত্রে গ্রামীণ পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ এসইজেড গ্রামীণ এলাকায় স্থাপিত হবে, যাতে এগুলো গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। বেশিরভাগ এসইজেড হবে ব্যক্তিমালিকানাধীন। কিছু সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনেও কিছু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হবে। নীতিনির্ধারকরা চেষ্টা করছেন এসইজেড স্থাপনের ক্ষেত্রে মূল্যবান কৃষিজমি এড়িয়ে চলার। অর্থাৎ কৃষিজমি নয় মূলত অনাবাদি ও পতিত জমিকেই এসইজেড স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হবে। সরকার কোনো কারণেই কৃষিজমিকে শিল্প স্থাপনে ব্যবহার করতে চায় না। উল্লেখ্য, দেশে কৃষিজমি ক্রমেই কমছে। কোনো কোনো গবেষকের মতে, বাড়িঘর, সড়কসহ অবকাঠামো নির্মাণ ও অন্যান্য কারণে প্রতি বছর কম করে হলেও এক শতাংশ আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে। এ অবস্থায় কোনোভাবেই আবাদি জমির ওপর চাপ সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। বিষয়টি অনুধাবন করে সরকার এসইজেড স্থাপনের ক্ষেত্রে অনাবাদি ও পতিত জমিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। উপযুক্ত জমি প্রাপ্তি শিল্পায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় পূর্বশর্ত। কিন্তু বাংলাদেশে শিল্প স্থাপনের মতো উপযুক্ত জমির খুবই অভাব। কয়েক বছর আগে জাপানি একটি শিল্পগোষ্ঠীর মালিক বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য এসেছিলেন। কিন্তু উপযুক্ত জমি পাননি বলে বিনিয়োগ না করেই দেশে ফিরে যান তিনি। জমির অভাব দূর করতে এসইজেডগুলো ব্যাপক অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। স্থানীয় ও বিদেশি উভয় শ্রেণির উদ্যোক্তাকে এখানে শিল্প স্থাপনের সুযোগ দেওয়া হবে। বিদেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মতোই আচরণ করা হবে। অর্জিত লভ্যাংশ নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে তাদের। শুধু তা-ই নয়, বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একধরনের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও গতিশীলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পঞ্জিকাবছরের শেষ প্রান্তিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধনের হার আগের তিন মাসের তুলনায় ৩৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। ৪৮৭টি প্রকল্পের বিপরীতে পাওয়া গেছে মোট ৬৮ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব। এটা আগের প্রান্তিকের চেয়ে ১৮ হাজার ৫১৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বেশি। তৃতীয় প্রান্তিকে ৩০৫টি প্রকল্পের বিপরীতে ৫০ হাজার ২৫১ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছিল। ওই সময় বিডায় সম্পূর্ণ বিদেশি উদ্যোক্তা ও যৌথ উদ্যোগে যেসব প্রকল্প নিবন্ধিত হয়, সেগুলোর প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ৪৫ হাজার ৭২৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আগের তিন মাসে এ ধরনের প্রকল্পে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৭৪০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ তুল্য সময়ে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। চতুর্থ প্রান্তিকে ৪৪৪টি স্থানীয় প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছে, যেগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ২৩ হাজার ৪৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তৃতীয় প্রান্তিকে ২০১৬ সালে বিডায় মোট ১৯ হাজার ৫১০ কোটি ১৭ লাখ টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছিল।
বিশ্বব্যাপী বর্তমানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একধরনের মন্থরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধনের এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা যে কোনো বিচারে উল্লেখের দাবি রাখে। বাংলাদেশকে বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশই বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত গন্তব্য বলে মনে করছে। নানা কারণে এ দেশে পুঁজি বিনিয়োগ অত্যন্ত লাভজনক। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে পুঁজি বিনিয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করছেন। কিন্তু একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হলেই শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয় না। বিনিয়োগ-পরবর্তী ট্রিটমেন্ট যদি ভালো না হয়, তা হলে বিনিয়োগকারীরা পুঁজি প্রত্যাহার করে চলে যেতে পারেন। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হচ্ছেন ‘শীতের অতিথি পাখি’র মতো। অতিথি পাখি যেমন কোনো জলাশয়ে প্রচুর খাবার ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না পেলে আশ্রয় নেয় না, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও তেমনই। পুঁজির নিরাপত্তা ও মুনাফার সম্ভাবনা না থাকলে ভিনদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন না তারা। তারা বলা যায় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। চাইলেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিনিয়োগ নিয়ে যেতে পারেন। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এটা পারেন না। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন হার খুব কম। বেশ কয়েক বছর আগের এক জরিপ থেকে জানা গেছে, বিনিয়োগ বোর্ডে যেসব প্রকল্প প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়, সেগুলোর মাত্র ৩৯ শতাংশ শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে সমর্থ হয়। অবশিষ্টগুলো বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রত্যাহƒত হয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ব্যাপকভিত্তিক অনিয়মের কারণে উদ্যোক্তারা একসময় প্রকল্প প্রস্তাব বাস্তবায়নে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত এসইজেডগুলো যেন বিনিয়োগবান্ধব হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া এসইজেডগুলো দ্রুতগতিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। কেউ যেন এগুলো বাস্তবায়নে বিঘœ সৃষ্টি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের মূল কারণ, এখানে রয়েছে ১৬ কোটি মানুষের এক বিশাল বাজার। স্থানীয়ভাবে মানুষের ভোগব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্য কিছু অঞ্চল থেকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে থাকে। এ সুবিধা ভোগের জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বরাবরই আগ্রহী।
এসইজেড স্থাপনের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। এ অঞ্চলের জন্য স্থান নির্বাচনে স্থানীয় নেতাদের রাজনৈতিক স্বার্থের পরিবর্তে জাতীয় গুরুত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে। দেশের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রয়েছে, এমন স্থানে এসইজেড গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে এসইজেড স্থাপন করতে হবে। ৬৪ জেলার প্রতিটিকে এসইজেডের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। এছাড়া ভৌগোলিক স্থান নির্দেশক পণ্যভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। যেমন যে অঞ্চলে যে পণ্য বেশি উৎপাদিত হয়, সে অঞ্চলে সেই পণ্যভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে। যেমন রাজশাহীতে প্রচুর আম উৎপাদিত হয়। সেখানে আমনির্ভর শিল্প গড়ে উঠতে পারে। এতে কাঁচামাল সরবরাহে সুবিধা হবে। টাঙ্গাইল তাঁতের কাপড় উৎপাদনের জন্য খ্যাত। বিভিন্ন জেলায় এমন নানা ধরনের পণ্য আছে, সেই পণ্যভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা যেতে পারে। একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ট্রাপ্রেনিউর অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশের সব এলাকায়ই কম-বেশি শিল্পোদ্যোক্তা আছেন। তাদের নিজ এলাকায় গিয়ে শিল্প স্থাপনে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে। এতে তারা স্থানীয়ভাবে নিজ এলাকার উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবেন। সর্বোপরি প্রস্তাবিত এসইজেডগুলোতে সব ধরনের বিনিয়োগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কেউ এখানে বিনিয়োগ করতে এসে দুর্ভোগের শিকার না হন। কারও বাধাই যেন বিনিয়োগকারীদের বিপাকে ফেলতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা চাই। যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে এসইজেডগুলো বাস্তবায়ন হলে তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক