ইসমাইল আলী: বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই বড় হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে ছয় শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। তবে ব্যবসায়িক সক্ষমতা অর্জনের দিক থেকে না এগিয়ে বরং পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। জেনেভাভিত্তিক বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গত বুধবার প্রকাশিত ‘দ্য গ্লোবাল এনাবলিং ট্রেড রিপোর্ট ২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, এনাবলিং ট্রেড সূচকে ১৩৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩। আর ৭-এর মধ্যে স্কোর ৩ দশমিক ৪০। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার নিচে রয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৪ সালে ১৩৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২০। সেবারও ৭-এর মধ্যে স্কোর একই ছিল। আর ২০১২ সালে প্রকাশিত সূচকে ১৩২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৯। সেবার স্কোর ছিল ৭-এর মধ্যে ৩ দশমিক ৫।
সাতটি উপসূচকের ওপর ভিত্তি করে এনাবলিং ট্রেড সূচকটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলো হলোÑঅভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবেশাধিকার, বৈদেশিক বাজারে প্রবেশাধিকার, সীমান্ত বাণিজ্যে প্রশাসনিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতা, পরিবহন অবকাঠামোর সহজলভ্যতা ও গুণগত মান, পরিবহনসেবার সহজলভ্যতা ও গুণগত মান, তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও ব্যবহার এবং ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশ। এগুলো আবার বিভিন্ন স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে পরিমাপ করা হয়েছে।
উপসূচক সাতটির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সীমান্ত বাণিজ্যে প্রশাসনিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০ ও স্কোর ৩। আর সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে বৈদেশিক বাজারে প্রবেশাধিকার উপসূচকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১২ ও স্কোর ৫ দশমিক ২। এছাড়া ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশে অবস্থান ১২৮, অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবেশাধিকারে ১২৭, তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতায় ১১২, অবকাঠামোর সহজলভ্যতা ও গুণগত মানে ১০৯ এবং পরিবহনসেবার সহজলভ্যতা ও গুণগত মানে ১০০।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বাণিজ্য সহজীকরণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন নানামুখী ব্যবস্থা নিচ্ছে। কৌশলগত এসব পদক্ষেপ ব্যবসায়িক সক্ষমতা বাড়াতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। আর বাংলাদেশ এখনও গতানুগতিক পথেই হাঁটছে। শুধু কর কাঠামো সহজ করে ব্যবসায়িক সক্ষমতা বাড়ানো যায় না। ফলে ব্যবসায়িক সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশ। এক্ষেত্রে বাণিজ্য-বিনিয়োগ সহজীকরণে পেপার ওয়ার্ক কমানো, সীমান্ত প্রশাসনের আধুনিকায়ন, অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে জোর দিতে হবে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এনাবলিং ট্রেড সূচকে এবারও শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর। ৭-এর মধ্যে দেশটির স্কোর ৫ দশমিক ৯৭। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা নেদারল্যান্ডসের স্কোর ৫ দশমিক ৭০ ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা হংকংয়ের স্কোর ৫ দশমিক ৬৬। শীর্ষ পাঁচে এরপর রয়েছে যথাক্রমে লুক্সেমবার্গ ও সুইডেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ১০৩, ভারত ১০২, ভুটান ৯২, পাকিস্তান ১২২ ও নেপাল ১০৮।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বাধা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু বাধা রফতানিতে ও কিছু আমদানিতে প্রভাব বিস্তার করছে। রফতানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো অনুপযুক্ত উৎপাদনপ্রযুক্তি ও দক্ষতা এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অর্থায়নের (ঋণপ্রাপ্তি) সমস্যা। এরপর রয়েছে সম্ভাবনাময় বাজার ও ক্রেতা চিহ্নিত করতে না পারা, পরিবহনগত জটিলতার কারণে পণ্য সরবরাহে দেরি হওয়া বা ব্যয় বৃদ্ধি, তুলনামূলক মূল্যে আমদানি করা কাঁচামালপ্রাপ্তির সহজলভ্যতার অভাব, ক্রেতার চাহিদা অনুপাতে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহে ব্যর্থতা প্রভৃতি। এর বাইরেও আরও কিছু বাধা রফতানি বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে।
এদিকে আমদানির ক্ষেত্রে বড় বাধা হলো শুল্ক ও আমদানি প্রক্রিয়াগত জটিলতা। এছাড়া সীমান্তে দুর্নীতি, পরিবহনগত জটিলতার কারণে বিলম্ব বা ব্যয় বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ কারিগরি প্রয়োজন ও মান, অপরাধ ও পণ্য চুরি হওয়া, অপর্যাপ্ত টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো আমদানি বাণিজ্যে বাধা হিসেবে কাজ করছে।
এসব বাধা দূর করতে পারলে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সক্ষমতা অনেকটাই বাড়বে বলে মনে করেন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকারকে বহুমুখী উদ্যোগ নিতে হবে। বাণিজ্যে বড় অংশীদারি দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তি করা যেতে পারে। এছাড়া দেশের ভেতরে সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি বন্দরগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে হবে।
প্রসঙ্গত, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বিশ্বের ১৩৬টি দেশ থেকে একই ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করেছে। এজন্য প্রতিটি দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য, অবকাঠামো, শুল্ক ও অশুল্ক অবস্থা সম্পর্কে প্রায় ১৫০টি প্রশ্নের উত্তর সরবরাহ করে সংস্থাটি।