নিজস্ব প্রতিবেদক: কভিড থেকে বাঁচতে গৃহীত অধিকাংশ উদ্যোগ ছিল রাজনৈতিক চিন্তা প্রসূত এবং অন্যদের অনুকরণ করে গৃহীত। অর্থাৎ অন্য দেশ করছে, আমরাও করি। এছাড়া জনগণকে দেখানো যে, সরকার তাদের জন্য দৃশ্যমান কিছু করছে। বিশেষ করে দীর্ঘ মেয়াদে লকডাউনের প্রয়োজন ছিল না। এতে যে পরিমাণ আর্থিক, সামাজিক ও মানসিক ক্ষতি হয়েছে, তার বিপরীতে সুফল তেমন আসেনি। পাশাপাশি কভিডের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ায় অন্যান্য রোগেও বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু সেদিকে নজর ছিল না গণমাধ্যমসহ নীতিনির্ধারকদের।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস সম্মেলন কক্ষে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. কাজী ইকবালের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আননিস চৌধুরী। তিনি তার রচিত ‘নুগেট ইন টু লকডাউন? বিহেভিয়ারাল ইকোনমিস, আনসার্টিনিটি অ্যান্ড কভিড-১৯’ শীর্ষক বই থেকে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করেন।
ড. আননিস চৌধুরী বলেন, কভিডে কিছুই করার দরকার ছিল না। তাহলে প্রাণ, জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ সবকিছুই বাঁচত। ব্রিটেনে যারা কভিডে মারা গেছেন তারা অধিকাংশই ঘরে ছিলেন। সুইডেনে যারা মারা যান, তারাও বেশিরভাগ ঘরেই ছিলেন। প্রথম দিকে স্বল্প মেয়াদে লকডাউন ঠিক ছিল। তখন বোঝা যাচ্ছিল না যে কোথা থেকে কী হচ্ছে। কিন্তু যখন সবকিছু পরিষ্কার হলো, তখন কেন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ লকডাউন দিয়েছিল। এর ফলে সব কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের যে মানসিক এবং শিক্ষায় ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ হতে আগামী দুই প্রজš§ লাগবে। লকডাউন যে জীবন রক্ষা করতে পারেনি তার উদাহরণ হচ্ছে ইউরোপীয় ২৪টি দেশে কঠিন ও হালকা লকডাউন ছিল। কিন্তু মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। কভিডের কারণে বিশ্বের দেশগুলোয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছিল কভিড নিয়ন্ত্রণ। ফলে অন্যান্য রোগসহ কোনো দিকেই নজর দেয়া হয়নি। মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ুও কমে গেছে। লকডাউনের কারণে অনেক অপারচুনিটি কস্ট হয়েছে। সেগুলোর দিকে নজর দেয়া হয়নি। নীতিনির্ধারকদের এটা বোঝার দরকার ছিল যে সম্পদ সীমিত। এটাকে একদিকে লাগালে অন্যান্য দিকে ব্যবহার করা যায়নি। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি শুধু যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বেড়েছে সেটি নয়। এর পেছনে কভিডের জন্য নেয়া উদ্যোগগুলোর প্রভাবও দায়ী। টিকার বিষয়ে তিনি বলেন, দুই থেকে চার ডোজ টিকা দিয়েও অনেককে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাহলে টিকার পেছনে এত সম্পদ ব্যয় করার দরকার কী ছিল।
মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়েছে, ১৯১৩ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা গিয়েছিল ২১৯ দশমিক ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। আর ২০১৯-২০ সালে কভিডে মারা গেছে ৬ দশমিক ৩১ মিলিয়ন মানুষ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্প্যানিশ ফ্লুর চেয়ে কভিড কোনোভাবেই বড় কোনো দুর্যোগ ছিল না। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল স্প্যানিশ ফ্লুতে সব বয়সের মানুষই মারা গিয়েছিল আর কভিডে একটু বয়স্ক মানুষই বেশি মারা গেছেন।
এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৫৭ সালের এশিয়ান ফ্লুতে মারা যায় ৪ দশমিক ৮১ মিলিয়ন। ১৯৬৮ সালের হংকং ফ্লুতে মারা যায় ২ দশমিক ১৮ মিলিয়ন মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছে কভিড-১৯। আরও বলা হয়েছে, কভিড মহামারির আগেও অন্যান্য রোগসহ স্বাভাবিক মৃত্যুও বিশ্বব্যাপী কম হয়নি। হিসাব করলে দেখা যায়, কভিডের চেয়েও সেসব মৃত্যু ছিল অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারি চলার সময় ক্যানসার, কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগেও মানুষ মারা গেছেন। এসব রোগের সঠিক চিকিৎসা ছিল না। এদিকে এসব মৃত্যুও খবর গণমাধ্যমসহ সবার মাঝে খুব বেশি আলোচনাও ছিল না। সবাই ব্যস্ত ছিলেন কভিডের মৃত্যুর হিসাব নিয়ে। ইংল্যান্ড ব্যাংকে কর্মরত অর্থনীতিবিদ ডেভিড মাইলসের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ৪ লাখ ৪০ হাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে যদি ৯ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হয় তাহলে ইংল্যান্ডের ক্ষতি হবে ৬৮ বিলিয়ন পাউন্ড। আবার মাত্র ২০ হাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে যদি ৯ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হয় তাহলেও ক্ষতি হবে ১৯৪ বিলিয়ন ডলার। যদি ২০ হাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে ১৫ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হয় তাহলে নিট ক্ষতি হবে ৩২৪ বিলিয়ন পাউন্ড। সুতরাং ক্ষতির বিষয়গুলো মাথায় নেয়ার দরকার ছিল।
ড. কাজী ইকবাল বলেন, সেমিনারের আলোচনা থেকে যা বোঝা গেল তা হচ্ছে করোনা মোকাবিলায় নেয়া উদ্যোগগুলোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চিন্তা ও দেখাদেখির বিষয়টিও কাজ করেছে। এর অর্থ ওই দেশ লকডাউন করছে, আমরাও করব। রাজনৈতিক চিন্তা হলো সরকার জনগণের জন্য কিছু একটা করছে। এটা দৃশ্যমান কিছু। যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে সরকার আমাদের পাশে আছে। তবে যদি নির্ধারণ পর্যায়ে তরুণরা থাকত তাহলে হয়তো এত লকডাউন হতো না। তুলনামূলক বয়স্করাই নীতিনির্ধারণ করেন বলেই লকডাউনের মতো কর্মসূচি তাদের পছন্দ ছিল। তবে করোনার কারণে দেখা গেছে, যারা তরুণ এবং কর্মজীবী মানুষ তারা বেশি মৃত্যুর মুখে পড়েননি। তুলনামূলক বয়স্করাই বেশি মারা গেছেন।