প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

কয়লার দাম না কমালে আদানির বিদ্যুৎ কিনবে না বাংলাদেশ!

চুক্তি সংশোধন চেয়ে চিঠি

ইসমাইল আলী: আদানির ঝাড়খন্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে আগামী মাসে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে। এ কেন্দ্রটির জন্য কয়লার দাম ধরা হয়েছে বাংলাদেশের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেশি। এতে আদানির বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গচ্চা যাবে মাসে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। তবে গচ্চা দিয়ে এ বিদ্যুৎ কিনতে রাজি নয় পিডিবি। এজন্য চুক্তি সংশোধনে আদানিকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।

সম্প্রতি পাঠানো এ চিঠিতে আদানি ও পিডিবির মাঝে সম্পাদিত বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি (পিপিএ) সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। চুক্তি সংশোধনের আগে আদানির বিদ্যুৎ কেনার জন্য চাহিদা দেয়া হবে না বলেও জানানো হয়।

পিডিবির তথ্যমতে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানিকৃত কয়লার দাম ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টন ২৪৫ ডলার। এক্ষেত্রে প্রতি কেজি কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু (তাপন ক্ষমতা) ধরা হয়েছে চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরি। একই মানের কয়লা আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ধরা হয়েছে ৪০০ ডলার। এ হিসাবে পায়রার বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির কেন্দ্রে কয়লার দাম বেশি ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টনে ১৪৫ ডলার বা ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ।

আরো পড়ুন :

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি আদানির সঙ্গে বৈঠকে তারা বিদ্যুতের চাহিদা দেয়ার দাবি জানায়। এ সময় তারা কয়লার দাম ৪০০ ডলার/মেট্রিক টন দাবি করে। তবে ওই মানের কয়লার দাম কোনভাবেই ২৫০ ডলারের বেশি হবে না বলে মনে করছেন পিডিবির কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে কয়লার দামে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা করে দাম নির্ধারণের কথা বলা হয়। এজন্য প্রয়োজনে চুক্তি সংশোধনের কথাও জানানো হয়।

সূত্রমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার (৮৫ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর) হলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়বে ১৩ টাকা ৮৯ পয়সা আর আদানির কেন্দ্রে ১৯ টাকা ৬২ পয়সা। অর্থাৎ পায়রার তুলনায় আদানির জ্বালানি ব্যয় বেশি পড়ছে ৫ টাকা ৭৩ পয়সা বা ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ।

এদিকে কয়লার দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিয়ে পিডিবি দেয়ায়, নিউক্যাসেল কোল ইনডেক্স অনুযায়ী গত ডিসেম্বরে কয়লার দাম ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৪০৪ ডলার। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে মানের কয়লা কেনা হচ্ছে, তাতে প্রতি মেট্রিক টনে ৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। চুক্তিমতে, প্রতি টন কয়লার দাম ১১০ ডলারের বেশি হলে বাড়তি দামের ৫৫ শতাংশ পরিশোধ করতে হয় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে।

পায়রার এ চুক্তির শর্ত দেশের অন্যান্য কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে আদানির সঙ্গে ২০১৭ সালে সম্পাদিত চুক্তিতে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা করা হয়নি। এতে চুক্তির ভুলে আদানির কয়লার জন্য পুরো দামই পরিশোধ করতে হবে। এতে চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার কয়লায় মাসে গচ্চা যাবে প্রায় ৬৪ মিলিয়ন ডলার বা ৬৮৪ কোটি টাকা (এক ডলার = ১০৬.৯৫ টাকা)।

সূত্রমতে, এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আদানির কেন্দ্রে বছরে ৭-৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার দরকার হবে। ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা না করা ও গোপন ব্যয়গুলো যুক্ত করলে এ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়বে ২০-২২ টাকা। অথচ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে এ ব্যয় পরে ১২ টাকার নিচে। তাই পিপিএ সংশোধন না করলে আদানিকে বিদ্যুতের চাহিদা দেয়া হবে না। প্রয়োজনে বসিয়ে রেখে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে।

তথ্যমতে, আদানির কেন্দ্রটির জন্য মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ না কিনলেও এ অর্থ দিতে হবে। এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে এ চার্জ বাবদ ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ২৬ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা (১ ডলার = ১০৬.৯৫ টাকা)।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরকারের দেয়া বাড়তি সুবিধা এখানেই শেষ নয়। চুক্তির শর্তের কারণে আরও সুবিধা পাবে আদানি। এক্ষেত্রে যদি আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ দিতে প্রস্তুত থাকে, তবে পিডিবি কোনো কারণে চাহিদা দিয়েও সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ না কেনে, তবুও আদানি কয়লার পুরো মূল্যই পাবে। তবে দেশীয় অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো শর্ত রাখা হয়নি।

আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির কপি খুঁজে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। চুক্তির ১৩.১-এর (জি) ধারার (৪) উপধারায় এ-সংক্রান্ত শর্ত রয়েছে। এতে দেখা যায়, ৮৫ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে (পূর্ণ ক্ষমতা) যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিপেনডেবল ক্যাপাসিটি ৭০ শতাংশ থাকে, তবে পিডিবি যদি ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেনে তাহলে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ কয়লার দাম পরিশোধ করতে হবে। আবার ৬০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে (অপূর্ণ ক্ষমতা) যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিপেনডেবল ক্যাপাসিটি ৭০ শতাংশ থাকে, তবে পিডিবি ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনলে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কয়লার দাম পরিশোধ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ জানুয়ারি শেয়ার বিজে ‘কয়লার দাম ধরা হয়েছে ৪২% বেশি: আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাসে গচ্চা যাবে ৭০০ কোটি টাকা!’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে আদানিসহ দেশের পাঁচটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ের তুলনামূলক বিবরণ তুলে ধরা হয়।

আরো পড়ুন :

আরো পড়ুন :