নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরও দেশের বেকার সংখ্যা বাড়েনি, বরং কিছুটা নিন্মমুখী। এখন মোট বেকারের সংখ্যা ২ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন বা ২৬ লাখ ৩০ হাজার জন। এর মধ্যে পুরুষ বেকার ১ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন বা ১৬ লাখ ৯০ হাজার এবং মহিলা শূন্য দশমিক ৯৪ মিলিয়ন বা ৯ লাখ ৪০ হাজার জন। আর কাজ করার জন্য মোট উপলব্ধি জনগোষ্ঠীর বিপরীতে ২০১৭ সালের তুলনায় অনেকটাই কমেছে বেকারত্বের হার। ২০১৭ সালে মোট শ্রমশক্তি ছিল ছয় কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে বেকার ছিল ২৭ লাখ। বেকারত্বের হার চার দশমিক ২৫ শতাংশ। আর ২০২২ সালের জরিপে মোট শ্রমশক্তির আকার দাঁড়িয়েছে সাত কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে বেকার মাত্র ২৬ লাখ ৩০ হাজার। এক্ষেত্রে বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে তিন দশমিক ছয় শতাংশ।
জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তাদের হালনাগাদ শ্রমশক্তি জরিপে এমন তথ্য জানিয়েছে। পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে ফের এ জরিপের কার্যক্রম শুরু করে সংস্থাটি। এখন থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর এ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করবে বিবিএস। জরিপের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বেকার জনগোষ্ঠী ছিল সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন এবং চতুর্থ প্রান্তিকে তা সর্বনি¤œ ২ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ছিল। বুধবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। রাজধানীর আগারগাঁও এ পরিসংখ্যান ভবন সম্মেলন কক্ষে প্রকাশনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
বিবিএসের মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহসানে এলাহী এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন শ্রম শক্তি জরিপের মাধ্যমে শ্রমবাজার তথ্যের উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আজিজা রহমান। বক্তব্য দেন বিবিএসের ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড লেবার উইংয়ের পরিচালক কবীর উদ্দিন আহমেদ ও পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. দিপংকর রায়।
বেকারের এই হিসাব করা হয়েছে একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞার ভিত্তিতে। সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের কোনো ব্যক্তি যদি গত ৩০ দিনে বেতন/মজুরি/মুনাফা বা নিজস্ব পণ্য উৎপাদনের জন্য কোনো না কোনো কাজ খুঁজে থাকেন তাহলে তিনি শ্রমবাজারের অন্তর্ভুক্ত হবেন। আর যদি তিনি এটি না করেন তাহলে তিনি শ্রমবাজারের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। আর এ ধরনের ব্যক্তিরা যদি গত ৭ দিনে অন্তত এক ঘণ্টা কাজ করে থাকেন তাহলে আর তিনি বেকার হিসেবে গণ্য হবেন না।
এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোট শ্রমশক্তি সাত কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার। এর বাইরে ১৫ বছরের ঊর্ধের জনগোষ্ঠী রয়েছে আরও চার কোটি ৬৯ লাখ। কিন্তু তারা শ্রমবাজারের আওতাভুক্ত নয়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শ্রমবাজারের আওতার বাইরের অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অধিকাংশই নারী। এক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা পুরুষের প্রায় তিনগুণ। এক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা তিন কোটি ৪৮ লাখ ১০ হাজার। আর পুরুষের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ ৯ হাজার। ২০১৭ সালের তুলনায় এ ধরনের জনগোষ্ঠী বেড়েছে ১৪ লাখ।
অন্যদিকে ২০১৭ সালের পর ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে শুমবাজারে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ৯৯ লাখ ১০ হাজার মানুষ। আর ২০১৭ সালের তুলনায় কমেছে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। সে হিসাবে পাঁচ বছরে এক কোটি কর্মসংস্থান হওয়ার কথা। কিন্তু শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বছরে ১২ থেকে ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়। সে হিসাবে পাঁচ বছরে ৬০ লাখের মতো কর্মসংস্থান হওয়ার কথা। তাহলে বাকি ৪০ লাখ কর্মসংস্থান কোথায় হলো, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেনি বিবিএস।
জরিপের হিসাব অনুযায়ী, কৃষিতে আগের তুলনায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত কৃষিতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়ে তা শিল্প ও সেবা খাতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৮০ সালে এ জরিপ শুরুর পর থেকে এমনটিই হয়ে আসছে। কিন্তু এবার কৃষিতে কেন বাড়লো সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিবিএসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, করোনাকালে অনেকে গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজ শুরু করেছেন। সে কারণে কৃষিতে শ্রমশক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, অর্থনীতিতে একটা রূপান্তর ঘটছে। সেটি গ্রামে গেলে বোঝা যায়। রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এখন মূল কাজ। অর্থাৎ শ্রমিকদের ন্যায্যতা ও মূল পাওয়া নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে। নারীদের পারিবারিক কাজ শ্রমশক্তির বাইরে আছে এটা দুঃখজনক। তাদেরটা যোগ করা হবে জিডিপি ৪৫০ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৬৫০ বিরিয়ন হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, করোনা সময় এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকা শহরে দারিদ্র্য কমেছে এবং বেকার সংখ্যা কমেছে। এর মূল কারণ হলোÑআমরা সীমিত লকডাউন করেছি। শিল্প কারখানা খোলা ছিল। রাস্তাঘাট খোলা ছিল। প্রধানমন্ত্রী দ্রুত প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। ফলে করোনার সময় ঢাকায় উল্টো চিত্র বিরাজ করেছে।
ড. শামসুল আলম বলেন, করোনার সময় শহরের যে চিত্র এর আগের এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, এতে মনে হয় করোনাই ভালো ছিল। কিন্তু সেটি তো আমাদের কাম্য হতে পারে না। কৃষিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনাকালীন শহর থেকে অনেক মানুষ গ্রামে গেছেন। সেখানে তারা কৃষিতে যুক্ত হয়েছেন। প্রচলিত শস্যের বাইরে শস্য বহুমুখীকরণে ভূমিকা রেখেছেন। তারা ফুল, ফল, মাছসহ নানা বৈচিত্র্যময় চাষে যুক্ত হন। পাশাপাশি যেসব জমি পড়ে ছিল সেগুলো চাষের আওতায় চলে আসে। ফলে কৃষিতে শ্রম শক্তি বেড়েছে। কিন্তু এটা পরবর্তীতে স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসবে।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, আইএলওর (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) সংজ্ঞা অনুযায়ী শ্রম শক্তির বাইরে বলতে সাধারণত ছাত্র, অসুস্থ, বয়স্ক, কাজ করতে অক্ষম, অবসরপ্রাপ্ত, গৃহিণীরা বিবেচিত হবেন। যারা গত সাত দিনে কোনো কাজ করেনি বা কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এছাড়া গত ৩০ দিনে কোনো কাজও খোঁজেননি এমন ব্যক্তিও এ শ্রেণিভুক্ত হবেন। কর্মে নিয়োজিত বলতে বোঝানো হয়েছে, গত সাত দিনে এক ঘণ্টা বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে কিংবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য ও সেবা উৎপাদনমূলক কাজ করেছেন এমন ব্যক্তি।