শাহারুল ইসলাম, বেনাপোল (যশোর) : দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত স্থলবন্দর বেনাপোল একসময় দিনরাত মুখর থাকত ট্রাকের হর্নে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারি থাকত বন্দরগেটে। কিন্তু এখন দৃশ্যপট বদলেছে। আগের সেই কর্মচাঞ্চল্য অনেকটাই হারিয়ে গেছে ট্রাকচালকদের জীবনে। চাকার ঘূর্ণন এখনও চলছে, কিন্তু আগের মতো নয়। ৫ আগস্টের আগে প্রতিদিন ইনকাম ছিল ভালো। এখন সপ্তাহে বা মাসে একবারই বেনাপোলে ট্রাক নিয়ে আসতে হয়।
গতকাল ভোর ৫টা। বেনাপোল বন্দরের ট্রাক টার্মিনালে আর আগের মতো ভিড় নেই। আগে যেখানে একসঙ্গে শত শত ট্রাক পণ্য নামাতে দাঁড়িয়ে থাকত, সেখানে দেখা যায় হাতেগোনা কয়েকটা ট্রাকের উপস্থিতি।
চালক সাগর হোসেন বলেন, আগে প্রায় প্রতিদিনই বেনাপোলে আসতাম। সপ্তাহে চার-পাঁচটা ট্রিপ হতো, আয়-রোজগারও ভালো ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর বন্দরে কার্যক্রম কমে গেছে। এখন কখনও সপ্তাহে, কখনও মাসে একবারই আসতে হয়।
চালকদের আয় আগের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। পণ্যবাহী ট্রিপ না থাকলে আয় নেই, অথচ ট্রাকের কিস্তি, ডিজেল ও খরচ একই রকম।
চালক মিজানুর রহমান বলেন, আগে দিনে দুই হাজার টাকার মতো রোজগার হতো। এখন এক সপ্তাহেও তেমন একটা ট্রিপই পাই না। বাচ্চার পড়াশোনা, বাড়ির খরচÑসবকিছুই কষ্টে চলছে।
বেনাপোল ট্রাক মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, আগের তুলনায় এখন বন্দরে ট্রাক চলাচল প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। কাস্টমসের সময়সীমা, আমদানি-রপ্তানির অনিয়মিত কার্যক্রম এবং প্রশাসনিক জটিলতা এর প্রধান কারণ।
যেসব ট্রাক আসে, তারা আগের মতোই দিনরাত বন্দরে অপেক্ষা করে। কেউ পণ্য নামানোর লাইনে, আবার কেউ কাগজপত্রের জটিলতায় আটকে থাকে। এ বিষয়ে চালক মারিফুল ইসলাম বলেন, কাজ না থাকলেও ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে, আমরা বসে থাকি। ঘুম ট্রাকের কেবিনেই, খাবার রাস্তার দোকান থেকে। আগে ব্যস্ততা ছিল, এখন অলস সময়ই বেশি।
ট্রাকচালকদের আয়ের পতনের প্রভাব পড়েছে স্থানীয় ব্যবসাতেও। টার্মিনালের পাশে থাকা হোটেল, চায়ের দোকান, গ্যারেজ ও ছোট খুচরা দোকানগুলোয়ও ক্রেতা কমে গেছে। হোটেল ব্যবসায়ী সুজন আলী বলেন, আগে দিনে ২০০ চালক খেত, এখন ৫০ জনও আসে না। বন্দরে ভিড় না থাকলে আমাদের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায়।
বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক মো. শামীম হোসেন বলেন, কাস্টমসের কিছু কারিগরি বিষয় ও সময়সূচি পরিবর্তনের কারণে সাময়িকভাবে ট্রাক চলাচল কমে গেছে। তবে ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
যারা একসময় সীমান্তের প্রাণ ছিলেন, সেই চালকরা আজ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। চালক সাগরের চোখে ক্লান্তি, তবু আশাÑবন্দরটা যদি আগের মতো সচল হয়, আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব। চাকার ঘূর্ণন ধীর হলেও স্বপ্ন থেমে নেই। বেনাপোল বন্দরের এই নেপথ্য নায়করা এখনও বিশ্বাস করেন, দেশের বাণিজ্যের চাকা একদিন আবার আগের মতো গর্জে উঠবে।
প্রিন্ট করুন



Discussion about this post