প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

কাজের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যস্ত তারকারা

মোহাম্মদ অংকন: স্টার বা তারকা শব্দটি নাটক ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের জন্য বহুল ব্যবহƒত। মূলত যারা অভিনয়ের মাধ্যমে বিশেষ পরিচিতি ও সুনাম অর্জন করেন, তারা তারকা হিসেবে গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের মাঝে পরিগণিত হয়। আকাশের নক্ষত্র বা তারা যেমন সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে, নাটক ও চলচ্চিত্র জগতের মানুষজন তেমনই ধরাছোঁয়ার বাইরে হওয়ায় তারকা বিশেষণটি তাদের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। এসব মানুষজনকে বাস্তবের জগতে তেমন দেখা মেলে না, দেখা মেলে শুধু টেলিভিশন ও সিনেমা হলের রঙিন পর্দায়। তাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অভিনয় কিংবা নাটক-চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত ভালো গুণাবলিগুলো সাধারণ দর্শক অনুকরণ-অনুসরণ করে থাকে। এভাবে তারকারা হয়ে ওঠে সবার আদর্শ বা ‘আইডল’। সাধারণ মানুষের থেকে তারকাখ্যাতি তথা নিগৃঢ় ভালোবাসা অর্জন করে অসংখ্য তারকাশিল্পী মরেও অমরত্ব লাভ করেছেন যাদের নিয়ে সাধারণ মানুষ কখনও নেতিবাচক ধারণা পোষণ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ খুঁজে পায়নি। বরং কিছু কিছু তারকাশিল্পীর আকস্মিক বিদায়ে ব্যথিত হয়েছে সাধারণ দর্শক। তাদের রেখে যাওয়া শিল্পকর্মে আজও খুঁজে ফেরে সোনালি দিনের স্মৃতি।

যুগের পরিক্রমায় তারকাদেরও জীবনবোধ, চিন্তাধারা ও কাজের ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। তাই প্রশ্নের জš§ দিচ্ছে বর্তমান সময়ে তারকাখ্যাতি পাওয়া অভিনয়শিল্পীরা কি আগের তারকাদের মতো সম্মান পাচ্ছেন? কিংবা তারা কি তারকাখ্যাতি সঠিকভাবে অর্জন করতে পারছেন? অর্জন করতে পারলেও ধরে রাখতে কি পারছে? এই সময়ে এমন কোনো তারকাশিল্পী নেই যে যাকে নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে না। বিতর্ক যেন তারকাদের পিছু ছাড়ছে না। কিন্তু কেন? আর এসব বিতর্কের জš§ কারা দিচ্ছে? গণমাধ্যম না কি তারকাশিল্পী নিজেরাই? তারকাশিল্পীদের অনপ্র্রভূত আচরণ, উদ্ভট কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাসহ নানান কারণে প্রায় আলোচনা-সমালোচনায় আসছে। গণমাধ্যম সেসব কর্মকাণ্ডকে রং মিশিয়ে পরিবেশন করে এক বিতর্ক থেকে আরেক বিতর্কের জš§ দিচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষ দেখা যাচ্ছেÑ তারকাখ্যাতি মাথায় নিয়ে কেউ কেউ কাজের চেয়ে বিতর্ক তৈরি করা ও সেটার ‘ফিডব্যাক’ পেতে ব্যস্ত থাকছে এবং থেমে যাওয়া আলোচনা-সমালোচনা থেকে পুনরায় বিতর্ক তৈরি করতে নিজেই যেন নিভে যাওয়া আগুনে কাঠখড়ি দিচ্ছে। কায়দাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে-সাধারণ মানুষ এখন যাকে নিয়ে বেশি বেশি কথা বলবে, সেই যেন সবচেয়ে বড় তারকা। বড় তারকা থেকে আজকাল আর মানসম্মত কাজ করা লাগছে না বলেই মনে হচ্ছে।

ইতঃপূর্বে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এত ছড়াছড়ি ছিল না, তখন তারকারা ছিল সুশোভিত ও মার্জিত। তারাও নিজের কাজের বাইরে অন্যকোনো দিকে মনোযোগ দিতেন না। তারা ধরেই নিতেন, আমার কাজটি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে আপনা-আপনি দর্শক চিনে নেবে। দর্শকরাই তাদের বিচারের মাপকাঠিতে তারকা হিসেবে আগলে নেবে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারকারা সরব হওয়ায় প্রত্যেকেই এখন সরাসরি দর্শক বা শুভাকাক্সক্ষীদের ‘ফিডব্যাক’ প্রত্যাশা করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টে যার যত ফ্যান-ফলোয়ার, তিনি যেন তত বড় মাপের তারকা। বর্তমানে স্টার বা তারকা শব্দের চেয়ে ‘সেলেব্রেটি’ শব্দটি বহুল ব্যবহƒত হচ্ছে। আর এই ‘সেলেব্রেটি’ তকমা অর্জনের লক্ষ্যে নতুন যারা অভিনয়শিল্পী হচ্ছে, তারা তাদের কাজের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাবিধ বিতর্কে জড়িয়ে থাকতে পছন্দ করছে। বরং যে মৌসুমে যাকে নিয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে, তার কাজ দেখতে মানুষ তত সিনেমা হলে ভিড় জমাচ্ছে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষ আলোচনা-সমালোচনা দেখে কথিত সেলেব্রেটি তারকাদের কাজ দেখতে গিয়ে হতাশ হচ্ছে দর্শক। এটা নিয়ে আবার যখন নিজেদের মতামত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রস মাখিয়ে প্রচার করছে, তখন আবার বিতর্ক হচ্ছে। এসব উদ্ভট বিতর্ক অযোগ্য অভিনেতাদেরও তারকাখ্যাতির মতো বিশেষণে জড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের সরব উপস্থিতির জন্য। আর গণমাধ্যমও তাতে শক্তপোক্তভাবে ইন্ধন জোগাচ্ছে। এতে করে তাদেরও বেশ কাটতি যাচ্ছে। টেলিভিশনগুলোর টিআরপি বাড়ছে রাতারাতি।

আজকাল আর পত্র-পত্রিকা বা টেলিভিশন নয়, হাতে থাকা স্মার্টফোনে ব্যবহƒত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট চালু করলেই দেখা মেলে কথিত তারকাদের উদ্ভট কাজকর্ম। তাই সাধারণ মানুষ সরাসরি কমেন্টের মাধ্যমে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ভালো হোক বা মন্দ, এই প্রতিক্রিয়ার প্রত্যাশায় চলচ্চিত্রজগতের মানুষগুলো আজকাল মরিয়া হয়ে উঠছে। অথচ আগেকার দিনের শিল্পীরা কাজের দিকেই শুধু মনোনিবেশ করতেন। তারা মানুষের সরাসরি প্রতিক্রিয়া পাওয়ার আশায় কোনো কাজ করেননি। তাদের নিয়ে পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লেখালেখি হতো। আর এখন নতুন কাজের প্রমোশনের প্লাটফর্ম যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, তেমনই আবার ভাইরালের মানদণ্ডে ‘সেলিব্রেটি’ হওয়ারও সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

তারকারা সাধারণ মানুষের জন্য অনুকরণীয়-অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, তাই তাদের ইতিবাচক দিকগুলো মানবজীবনে প্রতিফলিত করার একটা সুযোগ থাকেই। কিন্তু বর্তমান সময়ে তারকাদের ঘরের খবর যখন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলে আসছে, তখন মানুষের চোখে ধরা দিচ্ছে এক কালো অধ্যায়। এতদিন যাকে ‘আইডল’ ভাবা হতো, তার মাঝেও দেখা মিলছে খুঁত। সর্বাংশে তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন ও অভিনয়জীবনকে সাধারণ মানুষ মিশিয়ে ফেলছে। এসব করতে গিয়ে অনেক তারকা রাতারাতি নিজেদের ধ্বংসও করে ফেলছে। কেননা, এই সময়ে মানুষের মনে জায়গা নিতে যতটা না সময় লাগছে, জায়গা হারাতে তার চেয়ে কম সময় লাগছে। কথা হচ্ছেÑতারকারা থাকবে জনসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাদের পারিবারিবক বা ব্যক্তিগত জীবনের গল্প কেন সাধারণ মানুষ জেনে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ পাবে? তাহলে তারা কীসের তারকা? আর এসবের জন্য তারকারা নিজেরাই দায়ী। নিজেদের ‘সেলেব্রেটি’ হিসেবে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখতে সব বিষয় তুলে ধরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাই সাধারণ মানুষও এসব নিয়ে কথা-বার্তা বলে মনে রসদ জোগাচ্ছে।

আগেরকার দিনে অভিনয়শিল্পীরা পরিশ্রম করে নিজেদের ভালো কাজ দিয়ে তারকাখ্যাতি অর্জন করতেন। আর এখন বিতর্কিত কাজকর্ম করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে তারকাখ্যাতি অর্জন করছে। কোনো কারণ ছাড়াই উদ্ভট কোনো কারণে ভাইরাল হওয়া ব্যক্তিটিকেও এখন নাটক-সিনেমায় অভিনয় করতে দেখা যাচ্ছে। প্রযোজক-পরিচালক যখন দেখছে ওই মুখ ইন্টারনেট দুনিয়ায় ভাইরাল, নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে বানানো কনন্টেন্ট এই সময় জনগণ বেশি ‘খাবে’, ক্ষেত্রবিশেষ খাচ্ছেও। আর্থিকভাবে লাভবান হতে গিয়ে মানহীন নাটক-সিনেমা বানিয়ে আসল তারকাদের যেমন বিপাকে ফেলা হচ্ছে, তেমনই ভাইরাল তারকারা একটা নির্দিষ্ট সময় পর হারিয়েও যাচ্ছে। বরং মূলধারার শিল্পী ও পুরোনো কাজগুলোই মানুষ তাদের স্মৃতিতে বেশি দিন স্থায়ী করছে।

এটা বুঝতে বাকি থাকে না, তারকাখ্যাতির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা এখন একটা ‘ট্রেন্ড’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই যেন ‘ফেমসিক’। যত নিজেকে ভাইরাল করা যাবে, তত তার বাজারে কাটতি। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে চলচ্চিত্রজগতে চলছে ‘ভাইরাল’ হওয়ার তুমুল প্রতিযোগিতা। এটা এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা যা শিল্প-সংস্কৃতির মূল ভাবধারাকে বিনষ্ট করছে। এই সময়ে গ্রহণযোগ্য কাজের দিকে মনোযোগ কতজন তারকার আছে, তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনও তারকা আছে, যেখানে বিতর্ক সেখানেই পা রাখছে। মোদ্দাকথা, তারা বিতর্ককে ‘এনজয়’ করছে। কিন্তু জনগণ যে তাদের এড়িয়ে চলতে চেয়েও পারছে না। এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, না পারছে ধরতে, না পারছে ছাড়তে।

শিল্প-সংস্কৃতির জগৎটা একটা মার্জিত জায়গা বলেই বিবেচনা করা হয়। মানুষের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পেতে এখানে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। তাই যারা তারকা হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন, তাদের উচিত হবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের ‘ফিডব্যাক’ প্রাপ্তির আশায় সরব না হয়ে সংশ্লিষ্ট কাজে মনোযোগ দেয়া ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি করা। বিতর্কিত হতে পারে এমন বিষয়কে জনগণের সামনে আনার কোনো দরকার নেই। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট যেসব গণমাধ্যমকর্মী আছে, তাদেরও সচেতন হতে হবে, সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব আনতে হবে। শুধু শুধু রং মাখিয়ে সংবাদ প্রচার করে কাউকে রাতারাতি ‘সেলিব্রেটি’ বানানো বা তারকাখ্যাতি এনে দেয়া বন্ধ করতে হবে।

  ডিএমপির কম্পিউটার বিভাগের কর্মী