প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ের উপযুক্ত সময় এখনই

আনিসুর রহমান এরশাদ

সামাজিক সূচক, অর্থনীতি, মাথাপিছু আয়, জীবনযাত্রার মান, বেসরকারি খাত, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হলেও বিশ্ব যেভাবে এগোচ্ছে, সে তুলনায় আমাদের অগ্রগতি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্ভাবনা, সফলতা, বৈশিষ্ট্যসহ সার্বিক অবস্থা বিশ্বকে জানানোর মাধ্যমে আমরা কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং করতে পারি। ‘কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং’ বর্তমান সময়ে দেশের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় একটি ফলপ্রসূ এবং অত্যাধুনিক ব্যবস্থা, যা সুষম উন্নয়নের পথকে প্রশস্ত করে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে সহজ করবে, অর্থনীতিতে হবে প্রাণসঞ্চার। তাই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির উচ্চমাত্রায় দাঁড় করানো এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে জাতীয় পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার দিয়ে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং করতে হবে। ফ্রান্স মানেই মানুষ আইফেল টাওয়ারের নাম বলে, হল্যান্ড মানেই ফুলের দেশ, জাপান মানেই ভূমিকম্পের সঙ্গে লড়াই করে অপরাজেয় জাতি হিসেবে চেনে, চীন মানেই পরিশ্রমী জাতির নাম আসে। তেমনি আমাদেরও এমন কিছু করে দেখাতে হবে, যাতে বাংলাদেশ মানেই সেই ব্র্যান্ডের নাম চলে আসে।

কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং বা ‘দেশ পরিচিতি’ হচ্ছে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সফলতা, বিশেষত্বসহ সার্বিক খবর বিশ্বকে জানানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের নিজস্ব ইতিবাচক ভাবমূর্তি বিশ্বদরবারে পরিচিত করানোর জন্য কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতও এ পদ্ধতিতে তাদের দেশের আন্তর্জাতিক প্রচারের কাজ এগিয়ে নিয়েছে অনেক দূর। এটি একটি ফলপ্রসূ ব্যবস্থা, যা নিজের দেশের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় অন্য মাধ্যমগুলোর চেয়ে অনেক সফলভাবে কাজ করে। হাজার দেশের ভিড়ে বিশেষ একটি কারণে বিশ্ববাসীর মনে আস্থার জায়গা করে নেওয়াকে প্রাথমিকভাবে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং বলা যায়। কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং হচ্ছে দেশ ও জাতির সুনাম বৃদ্ধি করা, অন্য?দেশের ওপর নিজের দেশের গুরুত্ব, মর্যাদা তথা শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করা। কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং একটি ব্যাপক বিষয়। এর জন্য দরকার প্রচার, বিদেশিদের মনে আস্থা সৃষ্টি, দেশের আকর্ষণীয় দিকগুলো বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আর সেজন্যই ব্র্যান্ডিংয়ের সঙ্গে প্রয়োজন বিজ্ঞাপন ও প্রচারণার টুলসগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা। তবে এসব কিছুর সঙ্গে জড়িত থাকে কতগুলো সৃষ্টিশীল মানুষ, নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি, সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা। সমন্বিত প্রচেষ্টাই দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতে সহায়ক হয় এবং বিদেশিরাও ওই দেশ ও জাতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী হয়; বাড়ে আস্থা। সামগ্রিক কর্মকাণ্ড এমনভাবে পরিচালিত হতে হবে, যা দেশ ও জাতির ব্যাপারে অন্য দেশ ও জাতির মাঝে বিদ্যমান নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা পাল্টে দেয় এবং ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। বাংলাদেশকে বিশ্বে উচ্চ আসন দিতে এবং বাংলাদেশিদের মর্যাদার আসনে সমাসীন করতে সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধুলা, জ্ঞান-গবেষণা, বিনোদন, পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্য, জনশক্তি রফতানি, বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদন এ সব ক্ষেত্রেই কাজ হতে পারে।

জার্মানির একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ সফর শেষে দেশে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, দেশটি এত উর্বর যে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রে লাঙল লাগে না, আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে কদুর (লাউয়ের) বীজ বপন করলে দুই দিন পর লতা, কয়েক দিন পরে পাতা, এরপর কদু (লাউ) জন্মায়। অথচ দেশটির লোকেরা অশিক্ষিত ও অলস। তারা চিংড়ি দিয়ে মজা করে লাউ খায় আর গান ধরে ‘স্বাদের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী’। একজন জাপানি বিশেষজ্ঞের মন্তব্য ছিল বাংলাদেশটাকে আমাদের হাতে দেওয়া হলে আমরা বিশ্বকে কৃষিভিত্তিক শিল্পোন্নত দ্বিতীয় জাপান উপহার দিতাম। এ অবস্থায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে ও বর্তমান সরকারের দিনবদলের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং হতে পারে একটি কার্যকর হাতিয়ার। তাছাড়া ২০২১ সাল নাগাদ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যবসা-বাণিজ্য হতে পারে অন্যতম মাধ্যম। এ সম্পর্কে সমাজ সচেতনতা-কল্যাণচিন্তা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে নিতে সমন্বিত কর্মসূচি পরিচালনা করাটাই কাম্য। এক্ষেত্রে দেশের শিক্ষিত সমাজকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে, চালাতে হবে সমন্বিত প্রয়াস।

বাংলাদেশ নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন। কেউ বলেন তলাবিহীন ঝুড়ি, কেউ বলে বেশিদিন সাসটেইন করে না, আবার কেউ বলেন বাংলাদেশ ইজ মিরাকল। যিনি যা-ই বলুন, বাংলাদেশের রফতানি আয় এখন ২৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে। জিডিপি বেড়েছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন হয়েছে, তা অভাবনীয়। বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক লক্ষ্য ছিল ভিশন ২০২১ (যা হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা) এবং ভিশন ২০৪১ (বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা) বাস্তবায়ন। সেই লক্ষ্যে সরকার একটি পারস্পেক্টিভ প্ল্যান (২০১০-২০২১) এবং ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক প্ল্যান (২০১০-২০১৫) প্রণয়ন করে, যার লক্ষ্য হচ্ছে প্রদর্শিত সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশকে প্রযুক্তিচালিত মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করা। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেশের সার্বিক উন্নয়নকল্পে এমন দীর্ঘমেয়াদি ও বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ নজিরবিহীন। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ বিনিয়োগবান্ধব গন্তব্য হিসেবে ভারতের পরেই দ্বিতীয় অবস্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ ব্যাপক হারে বেড়েছে, বিশেষত উৎপাদনশিল্পে এবং সেবা খাতগুলো যেমন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো বিনির্মাণে। বাংলাদেশ এখন প্রধানতম আইটি আউটসোর্সিংয়ের গন্তব্য। এইচএসবিসি বাণিজ্যিক আস্থাসূচক রিপোর্টে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল রফতানিও একটি বলিষ্ঠ গতি পেতে যাচ্ছে, যা ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ শতাংশে দঁাঁড়াবে। যা সাম্প্রতিককালের উদ্যোগগুলোর ফলে এর স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার মান আরও উন্নত হয়েছে। এতে আরও পূর্বাভাস করা হয়েছে, বর্তমান দশকের বাকি বছরগুলোতেও বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধনশীল হবে এর বিনিয়োগ, বিশেষত অবকাঠামোগত দিকে।

শুধু আমরা বলি না, অন্যরাও বলে সমপর্যায়ের দেশগুলোর তুলনায় এ দেশ এগিয়েছে সামাজিক সূচকে। আমাদের ক্রিকেট উন্নতির কারণে দেশের নাম ছড়িয়ে পড়ছে, গার্মেন্ট ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, পর্যটন করপোরেশন কক্সবাজার আর রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বিশ্বে প্রচার করছে, আমরা নাম পেয়েছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কারণেও। আমাদের রয়েছে বিশাল জনশক্তি, যাদের আমরা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে পারি। আমাদের রয়েছে কম খরচে সেবাপণ্য উৎপাদনের সুবিধা। রয়েছে সমুদ্র উপকূলীয় ও আরামদায়ক আবহাওয়ার এক চমৎকার অবস্থান। আমাদের রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও আতিথেয়তার বিশ্বব্যাপী সুনাম। রয়েছে সৃজনশীল উদ্যমী তরুণ প্রজন্ম, যারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে দেশ-বিদেশে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। দেশের অর্থনীতি ও পর্যটন খাতের উন্নয়নে সরকার নতুন ধারণা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে পর্যটন এলাকাগুলোয় ট্যুরিজম অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ট্যুরিজম ইজেড প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্বোধন হয়েছে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড)। আগামী ১৫ বছরে পর্যায়ক্রমে চালু হবে মোট ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল; যেখানে অন্তত ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন মানুষের কাজের সুযোগ হবে।

অযুত সম্ভাবনার কারণেই অনেকের নজর এ দেশের দিকে। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, ভারত, চীন, জাপান, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ নানা দেশ ও সংস্থার এ দেশটির দিকে নজর দেওয়ার কারণ হিসেবে অনেকে শুধু এর তেল-গ্যাস-বন্দর প্রভৃতি সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক সম্পদ ও তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের কথা বলে থাকলেও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে অনেক বড় অর্থনৈতিক স্বার্থ। দেশটি আয়তনে বিশ্বের তিন হাজার ভাগের মাত্র এক ভাগ হলেও এর লোকসংখ্যা ৪০ ভাগের এক ভাগ, যা কিনা বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে ২০-৪০ গুণ বড় অনেক দেশেই অনুপস্থিত। আর এ বিশাল ভোক্তার জনসংখ্যার কারণে আয়তনে দরিদ্র হলেও দেশটি এক বিশাল বাজার। এই ১৮ কোটি লোকের বাজার দখল বিশ্বমোড়লদের অতিরিক্ত নজরের অন্যতম কারণ। কেননা অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতিকে উৎপাদনমুখীর পরিবর্তে ভোগমুখী করে তোলা হয়েছে দৃশ্যমান এসব দাতা দেশ ও সংস্থার পরামর্শে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, তৃতীয় বিশ্বের এ জনবহুল উন্নয়নশীল দেশটির রাজধানী শহরকে এখন বিশ্বের ‘সিটি অব শপিং মল’ বললে অত্যুক্তি হবে না। একটি শীর্ষস্থানীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাকেনজি’ এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, চীনের মতো বাংলাদেশের পোশাকশিল্পেরও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে।

আশার দিক হচ্ছে, ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান এবং আইটিকেন্দ্রিক তৎপরতা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এককভাবে মেড ইন বাংলাদেশ বা ডিজিটাল বাংলাদেশ অথবা হার্ট অব এশিয়া ব্র্র্যান্ড হতে পারে। বাংলাদেশের অপ্রচলিত পণ্য যেমন জুট বা পাট, হস্তশিল্প, প্রকাশনা, পর্যটন, সিমেন্ট, ইলেকট্রনিকসের মতো প্রায় ৩২টি সেক্টর নিয়ে ব্র্যান্ডিং করার সুযোগ আছে। ‘চাঁদপুর সিটি অব হিলশা’ নামে এ জেলাকে ব্র্যান্ডিং ছাড়াও অনেকে জেলাকেই নানাভাবে ব্র্যান্ডিংয়ের সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের ২৫টি দেশে প্রায় দুই কোটি পিস লুঙ্গি রফতানি হচ্ছে এখন থেকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান ২০ বছরে যে শিল্পে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বর্তমান বাংলাদেশের উদ্যোক্তারাও চেষ্টা করছেন  সেই লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে উন্নতির দিকে যাওয়ার। আমাদের নকশিকঁাঁথাসহ এরকম অনেক কিছু আছে। আমরা যে কাঁথাকে পিঠের নিচে ঘামে ভেজাই, সেটা একজন পশ্চিমাকে উপহার দিলে তিনি আয়নাতে বঁাধিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখেন। এটাও আমাদের সংস্কৃতির গৌরব। লোকসংস্কৃতি আমাদের সম্পদ সেটাই আমাদের পরিচিতি বহন করবে। সংস্কৃতির জন্য পর্যটন বাড়ে, সংস্কৃতির কারণে পণ্য ব্র্যান্ডিং হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীকে সুইজারল্যান্ডের মতো করে সাজানোর সুযোগও রয়েছে। (চলবে)

 

সাংবাদিক

[email protected]