বাকি অংশ…………
নিরাশার দিক হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বদনামের কারণে বিশাল তৈরি পোশাকের অর্ডার আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর হার দুই-তৃতীয়াংশই কমে গেছে। কম দাম সত্ত্বেও ফ্রিল্যান্সিংয়ে আমরা বারবার এগিয়ে বারবার পিছিয়ে পড়ছি অ্যাডভান্স সফটওয়্যার ফার্ম থাকা সত্ত্বেও এবং বিশ্বে বিশাল বাজার সত্ত্বেও আমরা সেলের দিক থেকে পিছিয়ে আছি। আমাদের বৈদেশিক মিশনগুলো এতই দুর্বল, অপেশাদার, অপূর্ণাঙ্গ, রাজনৈতিক আর স্ববিরোধী যে, দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইটি, পর্যটন, ব্যবসা ইত্যাদি উন্নয়নে বিদেশে যে কাজ করা দরকার, তা তারা সফলতার সঙ্গে এড়িয়ে চলে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়ে ভালো ও অ্যাভেলবল কনটেন্ট নেই। সরকারি বিভিন্ন দফতরে তথ্য-উপাত্ত থাকলেও সেসব তথ্য জনগণের জন্য বেশি উš§ুক্ত নয়। বিশেষ করে দেশের ট্যুরিজম প্রমোট করার জন্যও ভালো ও প্রয়োজনীয় কনটেন্ট নেই। যেসব কনটেন্ট দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পর্যটক আকৃষ্ট করা যায়। বাংলাদেশ সম্পর্কে কাতারি আরবিরা যত দূর জানেন, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ খুব গরিব একটা দেশ; এখানে জঙ্গিরা বোমা-বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, মানুষ পড়ালেখা জানে না, খেতে পায় না, বলার মতো কোনো রাস্তাঘাট নেই।
তারপরও বাংলাদেশের আকাশে এখন সম্ভাবনার সূর্য। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। সন্ত্রাসী হামলার সাময়িক ধাক্কাও ইতোমধ্যে কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। জনসংখ্যা অভিশাপ না হয়ে আশীর্বাদ হতে পারে, বোঝা না হয়ে সম্পদ হতে পারে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেলে। সোনালি আঁশখ্যাত বাংলাদেশের পাটকে বিশ্বের দরবারে ব্র্যান্ডিং করা যেতে পারে। সঠিক রাষ্ট্রীয় নীতি, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার হতে পারে সমগ্র বিশ্ব। মিরপুরের শাড়িপল্লির উৎপাদিত বেনারসি শাড়িকে বলতে পারি মিরপুরি শাড়ি। কেননা শাড়ি আমাদের, কাজ আমাদের, ডিজাইন আমাদের যাতে জামদানির মতো নিজস্ব একটা ব্র্যান্ডের প্যাটেন্টও অন্যদের হাতে চলে না যায়। বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ব্র্যান্ড ওয়ালটন, স্কয়ার, বেক্সিমকোকে ইন্টারন্যাশনালি রিকগনাইজড করার উদ্যোগ নিতে পারি। আমদানিকারক ব্যবসায়ী নয়, উৎপাদকরাই হবে রাষ্ট্রের সম্পদ। শুধু ট্যুরিজম সেক্টরটাকেও যদি প্রোপারলি ইউটিলাইজ করা যায়, উন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একদম প্রথম সারির দিকে নিয়ে আসা অল্প সময়ের মধ্যেই সম্ভব।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের তকমা ছড়িয়েছি। আমরা ঠিকই কিন্তু উদীয়মান বাঘ, গার্মেন্ট লিজেন্ড, ফিউচার আইটি ল্যান্ড, হার্ট অব এশিয়া, ল্যান্ড অব ফ্রেন্ডশিপ এরকম পজিটিভ কোনো তকমাই লাগাতে পারেনি। যত দিন না এটা করতে পারছি, তত দিন আমাদের অর্জনগুলো ফিকে হয়ে যাবে আর ব্র্যান্ড বাংলাদেশ তো বহুদূর। রানা প্লাজা ধ্বংস ও তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ড, স্পেকট্রাম গার্মেন্টের ধসে পড়ার অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার দৃশ্যপট আমাদের বারবার জাগিয়ে তোলে যেভাবে শত শত উদ্যোক্তা আর সাফল্যের ইতিহাস বিবর্ণ হয়েছিল এবং বাংলাদেশের পোশাকশিল্প গভীর সংকটে পতিত হয়েছিল। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেখানে বাস্তবতার আলোকে অনেক বেশি উৎপাদনমুখী হওয়ার কথা ছিল, সেখানে তা ফাটকা কারবারি ও প্রতারণার ফাঁদে বন্দি। দক্ষ ও কাজ জানা শ্রমিকরা অদক্ষ শ্রমিকদের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি রোজগার করে জেনেও কেন আমরা লাখ টাকা খরচ করে শ্রমিক পাঠাই, অথচ কয়েক হাজার টাকা খরচ করে কাজ শিখিয়ে পাঠাই না? অথবা শ্রমিকদের দক্ষ হয়ে ওঠার জন্য কোনো প্রচার চালাই না।
একটি ব্যাপারে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে না বললেই নয়, তা হচ্ছে পর্যটন। মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, ভারত ও সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির নাড়ির স্পন্দনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটনকে কেন্দ্র করে। আমাদের দেশেও পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা বিরাট। এ দেশের নদ-নদী, সবুজ-শ্যামল মাঠ, ফসলের ক্ষেত, ছায়াঢাকা গ্রাম, শানবাঁধানো পুকুর, গ্রামবাংলার মানুষের সরল জীবন বিশ্বের যে কোনো মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট করে। তাই যথাযথ বিকাশের মাধ্যমে শুধু পর্যটনশিল্প থেকেই বছরে হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে বাংলাদেশ। জীবনানন্দের রূপসী বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে বহু পরিব্রাজক ও ভ্রমণকারী মুগ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি পর্যটনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণ কেন্দ্রবিন্দুতে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের পর্যটন স্পটে বৈচিত্র্য রয়েছে। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণ, পরিচর্যা আর প্রচারের অভাবে সব কিছুই পর্যটকদের অজানা রয়ে গেছে।
এখন বাংলাদেশের কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং নির্মাণের বিষয়ে বেশি করে ভার্চুয়াল জগৎকে বেছে নিতে হবে এবং এর সর্বোচ্চ উপযোগিতা কীভাবে অর্জন করা যায়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও সচেতন হতে হবে। এখানে ইংরেজি জানা লোকের অভাব দূর করতে হবে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড চালু করতে পারি ব্যাপকভাবে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রচার করতে পারি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। ‘হার্ট অব এশিয়া’ হিসেবে প্রচার চালাতে পারি। গার্মেন্টশিল্পে ‘উই আর নাম্বার ওয়ান’ হওয়ায় সচেষ্ট হতে পারি। দেশে নতুন এক সম্ভাবনা ইলেকট্রনিক কমার্স। আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে দেশে ১০ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি করলে তারা দশ কোটি মানুষকে সেবা দেবে। শুধু চাকরি নয়, নতুন প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের দেশে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশের ব্যাপারে নেতিবাচক ইমেজ পরিবর্তন করতে হবে এবং সংগঠনগুলোকেও সহায়তা দিতে হবে। নিজেদের ‘লোকাল ব্র্যান্ড’ তৈরির দিকে আমাদের এখন নজর দেওয়া দরকার। শুধু বিদেশি পর্যটকদের নির্ভরতায় না থেকে ‘দেশকে চিনুন, দেশকে জানুন’; ‘ঘুরে দেখি বাংলাদেশ’ এরকম স্লোগানে দেশের মানুষকে দেশ দেখানোর লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচার চালানো প্রয়োজন। কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ের উপযুক্ত সময় এখনই।
সাংবাদিক
anisur88Ñgmail.com