নিজস্ব প্রতিবেদক: কোনো শিল্পকারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ (কমপ্লায়েন্স) না থাকলে ভবিষ্যতে দেশের বাজারে তাদের পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পের অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের মতো দেশেই বিশেষ তদারকি প্রতিষ্ঠান গঠন করে সব কারখানাকে কমপ্লায়েন্সের আওতায় আনা হবে। কমপ্লায়ান্ট হওয়ার ক্ষেত্রে কারখানাগুলোকে সরকার দীর্ঘমেয়াদে অর্থ সহায়তা দেবে; ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ), দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্ট্রিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) যৌথ আয়োজনে গতকাল এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। চামড়াশিল্প নিয়ে অনলাইনে ‘রিভাইভিং দ্য লেদার সেক্টর ইন দ্য আফটারম্যাথ অব কভিড-১৯’ বিষয়ক এ আলোচনার আয়োজন করা হয়।
ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে তিনটি পৃথক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক ও র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. এম আবু ইউছুফ।
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির পরিচালক ড. মিজানুর রহমান, ডিটিআইইডব্লিউটিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম জাহিদ হাসান ও ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জিনাত আরা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সালমান এফ রহমান বলেন, আমাদের দেশের শিল্পকারখানার বড় সমস্যা কমপ্লায়েন্স। তাজরীন ফ্যাশন ও রানা প্লাজার ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতাদের চাপে তৈরি পোশাকশিল্পে কমপ্লায়েন্স এসেছে। ব্র্যান্ডগুলোও স্বীকার করছে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্ট। তবে বড় সমস্যা স্থানীয় বাজারের জন্য যারা পণ্য উৎপাদন করেন তাদের। সর্বশেষ সেজান জুস কারখানায় আগুনের ঘটনা তার প্রমাণ। সব আন্তর্জাতিক পত্রিকায় এর শিরোনাম হয়েছে; যা আমাদের জন্য নেতিবাচক।
তিনি বলেন, ‘এখন প্রশ্ন হলো, স্থানীয় শিল্পকারখানাকে কীভাবে কমপ্লায়েন্সের আওতায় আনব। আমি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের মতো কিছু একটা করতে হবে। কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার জন্য কারখানাগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে অর্থ সহায়তা দিতে হবে। সরকার সেক্ষেত্রে কারখানাগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়ন করবে। ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।’
সাভার চামড়া শিল্পনগরী প্রসঙ্গে সালমান এফ রহমান বলেন, আমরা এখনও এটাকে কমপ্লায়েন্ট করতে পারিনি। সিইটিপির নকশা যারা করেছিল তারা কাজটি সঠিকভাবে করেনি। আমরা অত্যধিক মাত্রায় বুয়েটনির্ভর হয়েছি। কিন্তু বুয়েট আমাদের সাংঘাতিকভাবে ভুল পথে হাঁটিয়েছে। বারবার ভুল নকশা করেও তা স্বীকার করেনি। আমাদের ঘুরিয়েছে। তবে যেহেতু একটা অবকাঠামো হয়ে গেছে, তা ভেঙে ফেলা যাবে না। এখন এটাকে সংস্কার করে এগোতে হবে।
ড. আব্দুর রাজ্জাক তার প্রবন্ধে বলেন, করোনার এ সময়ে বৈশ্বিক বাণিজ্য ১০ শতাংশ কমলেও চামড়াজাত পণ্যের বাণিজ্য কমেছে ২২ শতাংশ। অর্থাৎ চামড়াজাত পণ্য খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অন্যদিকে বৈশ্বিকভাবেই নন লেদার পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। পাশাপাশি কাঁচামালের দামও বাড়ছে। ফলে চামড়াশিল্পের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে।
আবু ইউসুফ বলেন, চামড়াজাত পণ্যের তিনটি আইটেমে (লেদার, লেদার গুডস ও ফুটওয়্যার) গত বছর প্রবৃদ্ধি ছিল। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এর জন্য সব স্তরে কমপ্লায়েন্ট হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। পশু পালন, পশু জবাই, কাঁচা চামড়া প্রস্তুতকরণ ও ট্যানারি কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি জানান, এশিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে কমপক্ষে ১৫টি ট্যানারি কারখানাকে এলডব্লিউজির সনদ পাওয়ার ব্যাপার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চলছে।
আরেক প্রবন্ধে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, গত বছর চামড়াজাত পণ্যে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ২০১৯ সালের তুলনায় এটি ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। তবে বৈশ্বিক বাজারে বিপুল চাহিদা রয়েছে। বিশ্বে প্রতিদিন ৩০০ মিলিয়ন ডলারের জুতা বিক্রি হয়। এর চাহিদা কমবে না। ব্র্যান্ডগুলো এখনও টেকসই লেদার চায়। তবে লজিস্টিক ও শিপিং ব্যয় বৃদ্ধি আমাদের চামড়াশিল্পের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
শিল্প ব্যবস্থাপনা যথাযথ হলে চামড়া শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছেÑউল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, কোরবানির সময়ে চামড়া ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করতে হবে। দেশের কারখানাগুলোকে এলডব্লিউজি সনদ পাইয়ে দিতে একটি রোডম্যাপ তৈরির পরামর্শ দেন তিনি।
মঞ্জুর এলাহী বলেন, গত বছর যে প্রবৃদ্ধি চামড়াশিল্প দেখেছে তা টেকসই করতে হবে। এজন্য একটা মহাপরিকল্পনা নেয়ার প্রয়োজন। কমপ্লায়েন্স ছাড়া ব্যবসা করা যাবে না, এটা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, আমাদের অনেক কাঁচামাল থাকার পরও চামড়াশিল্প পিছিয়ে থাকার কারণটা বের করতে হবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। বলেন, তৈরি পোশাকের মতো এ শিল্পের ক্ষেত্রেও সমান সুযোগ দিয়ে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
রপ্তানির ক্ষেত্রে এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) ও শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের চুক্তির রয়েছে। ওষুধ শিল্পসহ কয়েকটি খাতে বিদ্যমান সুবিধা ২০২৬ সালের পরও যেন অব্যাহত থাকে সে আলোচনা চলছে।
আলোচনায় চামড়াশিল্প খাতের উদ্যোক্তা, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার নীতিনির্ধারক, শ্রমিক প্রতিনিধি, দাতা সংস্থা ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।