শে ক ড় ক থ ন………..
নামকরণের পেছনে রয়েছে লোকমুখে চলে আসা নানা মিথ, রহস্য। এ পর্বে ‘কুমিল্লা’ জেলার লোককথা গদ্যে সাজিয়েছেন শরিফুল ইসলাম পলাশ
গোমতী-মেঘনা-তিতাস-ডাকাতিয়ার লালিত কুমিল্লা প্রাচীন জনপদের একটি। এ জেলায় রয়েছে লালমাই, ময়নামতী, শালবন বিহার, শাহ সুজা মসজিদ, কোটিলামুড়া, চণ্ডীমুড়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওয়ার সিমেট্রি, ধর্মসাগর, রানীর দিঘিসহ নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন, যা ইতিহাসবিদ ও পর্যটককে টানে।
বর্তমান কুমিল্লা চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনস্থ একটি জেলা। প্রাচীনকালে এটি সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিল। পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হয়েছিল। ‘কুমিল্লা’ নামকরণ সম্পর্কে অনেকগুলো প্রচলিত মত-ধারণা রয়েছে। তবে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজক ওয়াঙ চোয়াঙয়ের তৎকালীন সমতট রাজ্য পরিভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে। তার বর্ণনায় ‘কিয়া-মল-ঙ্কিয়া’ নামক একটি স্থানের বিবরণ রয়েছে। সে শব্দটি থেকে প্রথমে ‘কমলাঙ্ক’, পরে ‘কুমিল্লা’ নামকরণ হয়েছে বলে পরবর্তীকালে মত দিয়েছেন পণ্ডিতরা।
এ অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শন থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে ত্রিপুরা গুপ্ত সম্রাটদের অধিকারভুক্ত ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, সপ্তম থেকে অষ্টম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে বৌদ্ধ দেববংশ রাজত্ব করে। নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা হরিকেলের রাজাদের শাসনাধীনে আসে। প্রতœতাত্ত্বিক তথ্যমতে, দশম হতে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ বছর এ অঞ্চল চন্দ্র রাজবংশের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
মধ্যবর্তী সময়ে মোগলদের হাত থেকে ১৭৬৫ সালে এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে কোম্পানি ১৭৬৯ সালে তৎকালীন ঢাকা প্রদেশে একজন সুপারিনটেনডেন্ট নিয়োগ করে। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লাকে কালেক্টরের অধীনে আনা হয়। এরপর ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা জেলা গঠনের মাধ্যমে ত্রিপুরা কালেক্টরেটের যাত্রা শুরু হয়। ১৭৯৩ সালে তৃতীয় রেগুলেশন অনুযায়ী ত্রিপুরা জেলায় একজন দেওয়ানি জজ নিযুক্ত করে সে বছরই তাকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৮৩৭ সালে ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের পদগুলোকে পৃথক করা হয়। ১৮৫৯ সালে পদ দুটিকে একত্র করা হয়। পরের বছর ১৯৬০ সালে তৎকালীন ত্রিপুরার বাংলাদেশ অংশের নাম করা হয় ‘কুমিল্লা’। তখনই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর পদটির নামকরণ হয় জেলা প্রশাসক।
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লার দুটি মহকুমা চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৃথক জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে কুমিল্লার সম্পৃক্ততার ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। ১৭৬৪ সালে সমশের গাজীর নেতৃত্বে সংঘটিত ত্রিপুরা রাজাদের বিরুদ্ধে ‘কৃষক আন্দোলন’, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২১ নভেম্বর প্রিন্স ওয়ালেসের ভারত ভ্রমণের প্রতিবাদে দেশব্যাপী ধর্মঘট, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় মোহিনী গ্রামের প্রায় চার হাজার চাষি রাজস্ব প্রদানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে লাকসামের হাসনাবাদে কৃষকদের মিছিলসহ বেশকিছু সংগ্রামী অতীত রয়েছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কুমিল্লার সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, লাকসাম, হোমনা, বেলতলী ও রসুলপুরসহ কুমিল্লার বেশ কয়েকটি স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সংগীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মণ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, কুমিল্লা মডেলের পথিকৃৎ ড. আখতার হামিদ খানসহ বহু গুণী মানুষের স্মৃতিধন্য এ জেলা।