শাহিন আলম: আমাদের মানসিক বিকলঙ্গতার একটি চরম বহিঃপ্রকাশ দিয়ে শুরু করতে চাই এবং তা হলো ‘কৃষক’ পেশাকে ঘৃণা বা অবজ্ঞার চোখে দেখা। যদিও কোনো পেশা কখনও মহৎ হতে পারে না, মহৎ হয় ব্যক্তি এবং সেই ব্যক্তি যেকোনো পেশায় নিযুক্ত থাকতে পারেন। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫০ জনেরও অধিক শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি, যেখানে ১২০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী নিজেদের কৃষক কিংবা দিনমজুরের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে বেশ ইতস্তত বোধ করেছেন। শুধু সন্তানেরা নয়; গ্রামীণ পর্যায়ে বেড়ে ওঠার দরুন আমি দেখেছি অবস্থা এমন রূপ নিয়েছে যে, কৃষকরাই আজ নিজেদের ঘৃণা করতে শুরু করেছে। তাদের অনেকেই এই পেশা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। অবশিষ্ট যারা রয়েছেন তারাও চান না তাদের সন্তানরা অন্তত এই পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করুক। সন্তানরা যেন অন্য কিছুর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেÑ এমনই তাদের প্রত্যাশা।
কৃষিকাজ পৃথিবীর প্রাচীন পেশাগুলোর মধ্যে একটি, যা আজ পর্যন্ত সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান জুগিয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষপটে যদি হিসাব করি তাহলে দেখতে পাই, ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ৬২ শতাংশ এখনও কৃষিতে নিয়োজিত। অথচ আবহমানকাল ধরে কৃষকের প্রতি সমাজের অবহেলা, জমিদার শ্রেণির অত্যাচার এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় আর্থিক যে বৈষম্য এবং সেটার প্রভাবে কৃষকের যে নিদারুণ কষ্টের জীবন, তা আমরা বেশ পরিলক্ষিত করেছি, করছি, হয়তোবা আগামীতেও করব।
আমাদের দেশের ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবেই ঝড়, প্লাবন কিংবা খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করে একজন কৃষক ফসল উৎপন্ন করেন। নানা সংগ্রাম কিংবা সামাজিক অবজ্ঞা উপেক্ষা করেও যে একজন কৃষক নতুন উদ্যোমে তার পেশা চালিয়ে যান, এটি ইতিহাসে সত্যিই বিরল। এমন একটি পেশাকে ঘৃণার চোখে দেখা এবং কৃষকদের সঙ্গে অচ্ছুতের মতো আচরণের ফলে সমাজে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, তা সামান্য হলেও বোধগাম্য করা যায়।
পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের-ই অর্থনীতির একটি বৃহৎ ক্ষেত্র বা প্রাকৃতিক উৎস রয়েছে। যেমনÑসৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের প্রাকৃতিক উৎস তেলের ওপর নির্ভরশীল। তেমনি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক উৎসের কথা যদি বলি, তাহলে নদী-নালা, খাল-বিল এবং কৃষিজমির কথা উল্লেখ করতে পারি। যেহেতু আমাদের অর্থনীতির একমাত্র প্রাকৃতিক উৎস ও বৃহৎ চালিকাশক্তি হলো কৃষি; সেহেতু যদি আমরা এ শক্তিতে দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণ প্রজš§কে যুক্ত করতে পারি, তাহলে এক দশক পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির চিত্রপট পাল্টে যাবে। আজ বাংলাদেশে বেকারত্বের হার প্রসঙ্গে যদি কথা বলি তাহলে দেখতে পাই, ‘দ্য গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ’ বা ‘বিশ্বজুড়ে তরুণদের কর্মসংস্থানের প্রবণতা ২০২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে আইএলওর তথ্যানুসারেÑএই মুহূর্তে বাংলাদেশি তরুণদের বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, যদিও জাতীয় পর্যায়ের বেকারত্বের হার মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ। যার বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট করা উচ্চশিক্ষিত তরুণ। অথচ তরুণদের এই বড় একটি অংশকে আমরা খুব সহজেই কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি। যারা কৃষিক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তি ও মেধার প্রয়োগ ঘটিয়ে দেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু আমাদের দেশের সমাজব্যাবস্থা কিংবা সিস্টেম, উপর্যুক্ত পেশার অবমূল্যায়ন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া উপর্যুক্ত শিক্ষার্থীদের মানসিকতা এবং সংশ্লিষ্ট মহলের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সদিচ্ছার অভাবের দরুন এমন সংকটের সমাধান সম্ভব হচ্ছে না কিংবা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার আমরা করতে পারছি না। অথচ আমরা যদি সমাজতান্ত্রিক চীনের কথা উল্লেখ করি, তাহলে দেখি তৎকালীন রাশিয়া চীনকে একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল কিন্তু চীন তাদের কৃষিজমির যথাযথ ব্যবহার করে ক্রমান্বয়ে নিজেদের আজ বিশ্ব অর্থনীতির মোড়ল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
অনেক জ্ঞানী মানুষ আজ তরুণদের অধঃপতন থেকে রক্ষা পেতে পরামর্শ দিয়েছেন- ‘বিলাসিতা ত্যাগ করে সম্পদকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করা।‘ অনেক অর্থনীতিবিদ বলেছেন- ‘অপ্রয়োজনীয় শিল্পের পিছে না ছুটে এমন সব শিল্পের পেছনে ছোটো, যা দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করবে’। অনেক প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান পরামর্শ দিয়েছেÑ‘শৌখিন পণ্য তৈরি না করে মাঠে গিয়ে ফসল উৎপাদন করো, যেন আগামীতে ক্ষুধার্ত থাকতে না হয়। এসব সতর্কবাণীর উদ্দেশ্য হলো- আমাদের যুবসমাজ যেন সময় ও শ্রম ভুল পথে নষ্ট না করে। আজ খাদ্য ঘাটতি ও বেকারত্ব যে পৃথিবীর প্রকটতম দুটি সমস্যা, তা দলিলসহকারে উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই দুটি সমস্যার উপযুক্ত সমাধান যা হতে পারত, তা আমরা ঘৃণা বা অবজ্ঞার চোখে এড়িয়ে চলছি। মানুষ আজ সে পথেই হাঁটছে, যে পথে দ্রুত সম্পদ উপার্জন করা যায়; তা মদ-সিগারেট বা শৌখিন পণ্যসামগ্রীর মাধ্যমে হলেও। আসলে মহাদুর্যোগে পতিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মানবসমাজ হয়তো উপলব্ধি করতে পারবে নাÑতারা জ্ঞান ও মানসিকতাকে কতটা ভুল পথে পরিচালিত করেছে।
শিক্ষার্থী
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়