প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

কে বলেছে মাগো তুমি অচ্ছুৎ

দীপংকর গৌতম: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনের (ডিএসসিসি) টিকাটুলী রাজধানী সুপার মার্কেটের দেয়াল ঘেঁষে একটি টং দোকানের পাশে অজস্র মায়ের ভিড়। বিভিন্ন বয়সী মায়েরা রঙিন শাড়ি আর সিঁদুরে যেন বিবর্ণ সকালে রং ছড়াচ্ছিল। এদের সবার হাতে গ্লাস। চায়ের দোকানদার দূর থেকে তাদের গ্লাসে চা ঢালছে। এরা কেন গ্লাস নিয়ে এসেছে, জানতে চাইলে দোকানি জানাল, এরা তো সুইপার।

এদের থেকে টাকা কম নেয়া হয় না, চায়ের পরিমাণও সবার মতো দেয়া হয়, তারপরও এরা অচ্ছুৎ। দোকানের কাপে এদের চা খাওয়ার অধিকার নেই। এসব মা ও তাদের সন্তানরা আমাদের জীবন যাপন আরামদায়ক, পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর করে অথচ তারাই অচ্ছুৎ!

প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠার আগে সারাদেশের শহরগুলো যারা ঝেড়ে-মুছে ঝকঝকে, তকতকে করে রাখে, যারা আমাদের শরীরের বর্জ্য সাফ করে আধুনিক নগরায়ণকে গতিশীল করে। সহজ বাংলায় এদের পরিচ্ছন্নতা কর্মী আখ্যা দেয়া হলেও এরা ‘সুইপার’ নামেই পরিচিত এবং অবহেলিত সমাজে সবার কাছে। সমাজের গরল সাফ করা এসব মানুষ ব্রিটিশ আমলে কানপুর, দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছিল এদেশে রুটি-রুজির অন্বেষণে। কিন্তু ধর্ম-কর্মের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে এরা এগোতে পারেনি এখনও। সমাজে এরা মানুষ হয়েও ‘অচ্ছুৎ’। ভারতের বাপুজি মহাত্মা গান্ধী এদের ভগবানের প্রিয়পাত্র হিসেবে ঘোষণা করে নাম দেন ‘হরিজন’। কিন্তু সমাজ সামাজিকতায় এদের অবস্থান অচ্ছুৎ, দলিত। হরিজন পল্লির বাসিন্দারা তাদের পল্লিতেই দিন যাপন করেন। বর্তমান সরকার তাদের অনগ্রসর দলিত সম্প্রদায়ে অধিভুক্ত করলেও কালের বিবর্তনে কেবল তাদের নাম ও পরিচয়ের হেরফেরই হয়েছে, সে অর্থে ভাগ্য, সম্মান এবং অবস্থানের আজও কোনো পরিবর্তন হয়নি তাদের সমাজে এবং আমাদের কাছে। সামাজিক মর্যাদা বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই নেই এ জনগোষ্ঠীর।

তাদের পল্লিতে গেলে মনে হবে দেশের মধ্যে এ কোন এলাকা! ব্রিটিশ আমলে করা পল্লি তেমনই আছে। ছোট ছোট খুপরি ঘর, তার মধ্যেই আদিমভাবে জীবনযাপন করে বেঁচে থাকে হরিজনরা কোনোরকম। ব্রিটিশরা দেশ থেকে চলে গেলেও সুইপার কলোনির এলাকা আর বাড়েনি। অতটুকু ঘরে কাপড়ের ঘের দিয়ে শম্ভুনাথ তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে থাকেন কোনোমতে। বাসস্থান বলতে এই পল্লি। বৃষ্টির দিনে জল পড়ে। গরমে অসহ্য গরম। একটু বাতাস ঢোকে না। শম্ভুনাথ বলেন, এ চাকরি ছাড়লে তো জায়গা হাতছাড়া হবে, তখন কোথায় যাব? কথা হয় রছমিড রানার সঙ্গে। তিনি একটা এনজিওতে কাজ করেন। তিনি বলেন, এখানে শিক্ষা-স্বাস্থ্য বলে কিছু নেই। মেয়েরা সবচেয়ে কষ্টে থাকে। এখানের পুরুষরা রাতে চুল্লু (একধরনের দেশি মদ) খেয়ে এসে বউকে মারবে, এটা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে নারীরা সংগঠিত হয়ে এটা কমিয়েছে অনেকটাই। এসব নারীদের শক্তি এখন ৯৯৯। বেশি ঝামেলা করলেই ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশ ডাকে। পথে-ঘাটে তাদের প্রতি উত্ত্যক্ত করাও কমেছে ৯৯৯-এর বদৌলতে। তবে এ জনগোষ্ঠীর নারীরা জানান, এখনও তাদের কেউ ঘরে ঢুকতে দেয় না। অচ্ছুৎ বলে প্রায় ক্ষেত্রেও যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া যায় না। এই কলোনিতে প্রায় চার হাজার মানুষের বসবাস। এখানে পানির কল (ট্যাপ) মাত্র ৫টা। শৌচাগারে ৫টা যখন জল আসে, শুরু হয় মেয়েদের দৌড়। বালতির জলের ঢেউয়ে ভিজে যায় পুরো পল্লি। এই জল শিগগির শুকোয় না। পুরোনো পল্লির ভ্যাপসা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ এবং এ পল্লির নিত্যসঙ্গী বাংলা মদের কারণে এখানের পুরুষরা অল্প বয়সেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। মারাও যায় দ্রুত। তাই বিধবার সংখ্যাও বেশি এ পল্লিতে। বিধবাদের এখানে অনেক ঝামেলা সহ্য করতে হয়। শিক্ষা বলতে এখানে এনজিওর স্কুল। চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানসহ নানা সংকটে যেন না মরে বেঁচে আছেন এ পল্লির বাসিন্দারা।

সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব দিক থেকে তারা পিছিয়ে অথচ গাবতলী বা স্বামীবাগ মিলে এ জনগোষ্ঠীর শিল্পীর সংখ্যা অনেক। কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী সবই তাদের আছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ নেই বলে সুইপার কলোনির শিল্পীদের বিকাশ নেই। তাদের জীবনের এসব কাহিনি কাউকে বলার নেই, যদিও তারা অনেকেই ভোটার। এ দেশেরই নাগরিক তারা।

শহরের ময়লা-আবর্জনা সাফ করার অসাধ্য কাজটি করলেও তারা এখনও এ সমাজেরই বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। তবে আশার কথা হলো, এ জনগোষ্ঠীর কিছু ছেলে-মেয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে লক্ষ্মী রানী। তিনি বলেন, তারা ছোট থাকতে দেখছে, তাদের মা-মাসিকে কোনো হিন্দু ঘরে বা মন্দিরের কাছেও যেতে দিত না। তারা গ্লাস নিয়ে না গেলে সবার কাপে চা-ও দেয়া হয় না। এত বঞ্চনা দেখতে দেখতে প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে হয়। স্কুল-কলেজে ভর্তির সময় তারা পরিচয় লুকিয়েছে। নতুবা ভর্তি করতেও চাইত না স্কুল তাদের।

এ জনগোষ্ঠীর পুরুষরা কোনোভাবে দিন কাটালেও সংকটে থাকেন নারীরা। রাস্তা-ঘাটে নারীদের ডাকা হয় অবহেলা করে। যত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সুইপার কলোনির একটা মেয়ে এবং বউকে জীবন সংগ্রাম করতে হয়, এমন সংগ্রাম বোধহয় আর কাউকে করতে হয় না। একটা মেয়ে বিধবা হলে, জীবন বাঁচাতে যে কারও বাসায় কাজ করে খাবে, তার সুযোগও নেই। কারণ এরা অস্পৃশ্য। বেকারত্ব এখানের সবচেয়ে বড় সমস্যা। সুইপার কলোনির কাউকে কাজে রাখা যায় না। শিক্ষিত হলেও না। এখানকার ছেলে-মেয়েরা এনজিওর স্কুলে প্রাথমিক স্কুলের গøি পার করলে সংকটে পড়ে। সব লুকানো গেলেও কেউ কি তার ভাষা সংস্কৃতি লুকাতে পারে? তাছাড়া একটা সভ্য সমাজে তা লুকাতেই হবে কেন?

এ পল্লির মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ পল্লিতে কোনো শিশুকে আসতে দেয়া হয় না। এরা বাইরের শিশুদের ছুলে জাত যাবে, এমন ভাবা হয়। অথচ এ পল্লির অনেক মা-মেয়েরাই সন্তান প্রসবের কাজ চৌকষ ধাত্রীর কাজ করে। এ জনগোষ্ঠীর মানুষ শিক্ষিত হলেও চাকরি কঠিন, যদিও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচ্ছন্নতা কর্মীর চাকরি বংশগতভাবে তাদের অগ্রাধিকার। কিন্তু গোপনে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ হরিজনের সার্টিফিকেট নিয়ে মূল হরিজনদের চাকরি নিয়ে নিচ্ছেÑএমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে প্রায়ই। এতে করে বংশগতভাবে যারা হরিজন, তারা ঠকছে চাকরিপ্রাপ্তির এ সুযোগ থেকে। বঞ্চনা যেন তাদের পিছু ছাড়ে না। হরিজনদের ছেলে-মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চাকরি না পেয়ে পিতা-মাতার কাজে সহায়তা করতে করতে সেও সুইপার বনে যায়। মুক্তি মেলে না তাদের। লেখাপড়া জানলেও তারা অচ্ছুৎ। কোনো অনুষ্ঠান, উৎসবে তাদের কেউ ডাকে না। তাদের বাড়িতেও কেউ আসে না। পরিচ্ছন্নতায় তারা পিছিয়ে নেই। তবুও জাত-পাতের বেড়াজালে তাদের আটকে রাখে আমাদের সভ্য সমাজ। আশা রানী জানান, তিনি কলেজে পড়লেও তাকে মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হয়, যদিও তার মা-মাসিদের সময়ের চেয়ে পরিস্থিতি এখন অনেক বদলেছে, যদিও এদের জীবনের অনগ্রসর দিকটি দেখিয়ে বহু সংগঠন, এনজিও অনুদান আনলেও তাদের জীবন পাল্টানোর ব্যবস্থা ব্যাপক অর্থে সেভাবে নেই। সরকারি উল্লেখযোগ্য কোনো অনুদান বরাদ্দ নেই এ জনগোষ্ঠীর জন্য। তবে সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এদের উন্নয়নে কাজ করতে।

বাংলাদেশের সুইপার কলোনি, ঋষি কলোনি, বাঁশফোড় কলোনির নামের সঙ্গে যেন মিশে আছে অচ্ছুৎ বিষয়টি। ঈদ-পূজায় ওদের কেউ দাওয়াত করে না, ওরা পূজায় দাওয়াত করলে কেউ ওদের পল্লিতে আসে না। কোথাও বেড়ানোর সুযোগ নেই তাদের। কার কাছে যাবে তারা? সবখানে ওরা অচ্ছুৎ। অন্তহীন অভিযোগ নিয়ে যুগ যুগ ধরে বাস করছে দলিত সম্প্রদায়ের এসব মানুষ। অনগ্রসর এ জনগোষ্ঠীকে আলোর পথে আনার কোনো সামাজিক আন্দোলনও নেই সে অর্থে। এই একবিংশ শতাব্দীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যদি ‘দলিত’ শব্দটি উচ্চারণ করতে হয় আমাদের এখনও; সেটা আমাদেরই অনগ্রসরতা যতটা না এ জনগোষ্ঠীর। এই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করেছে আমাদের বাংলাদেশ। এখনও মানুষকে বিভাজনের জালে বন্দি করে রাখলে আমাদের মানবিক উন্নয়ন আর কবে ঘটবে? এ জন্য সরকারের সুদৃষ্টির সঙ্গে প্রয়োজন একটি বিশাল সামাজিক আন্দোলন। এমন একটি সমাজের স্বপ্ন হোক আমাদের অঙ্গীকার, যেখানে থাকবে না কোনো সম্প্রদায় বিভাজন, যেখানে মানুষ বলতে সবাই বুঝবে শুধু মানুষ কেই অচ্ছুৎ বলে কোনো শব্দ থাকবে না আমাদের মনে এবং সমাজে।

পিআইডি নিবন্ধ