দেশে প্রতি বছরই কোটি টাকার হিসাবধারীর সংখ্যা বাড়ছে। দৈনিক শেয়ার বিজে গতকাল ‘কোটিপতি আমানতকারী এক বছরে বেড়েছে ৮ হাজার’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে। এমন এক সময় এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো, যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে সাধারণ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি পরিস্থিতি। একদিকে সাধারণ মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন, অন্যদিকে ব্যাংকের কোটি টাকার হিসাবধারীর সংখ্যা বাড়ছে। এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, দেশে বৈষম্য চরমভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর বৈষম্য হ্রাস করার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে একটি প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা প্রবর্তন। সে জন্য প্রয়োজন কর কাঠামোর আমূল সংস্কার। কিন্তু আমাদের দেশে কর ব্যবস্থা সংস্কারে এখনও পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে ধনী জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে আশানুরূপ কর আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সেই কর ব্যবস্থাকেই আদর্শ ও ন্যায়ভিত্তিক কর ব্যবস্থা বলা যাবে, যে কর ব্যবস্থায় ধনীদের থেকে সম্পদ বেশি পরিমাণে সংগৃহীত হয়ে সমাজের দরিদ্র শ্রেণির কল্যাণে ব্যয় হবে। কর ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার বা ট্যাক্স জাস্টিস প্রতিষ্ঠা করার জন্য শত শত বছর ধরে গবেষণার পর উন্নত বিশ্বে যে চর্চা চালু করা হয়েছে আমাদের এখানে তা করা সম্ভব হয়নি। ফলে ধনিক শ্রেণির কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করা যাচ্ছে না।
সেই কর ব্যবস্থাকেই আদর্শ কর ব্যবস্থা বলা যাবে, যেখানে প্রত্যক্ষ কর আহরণের পরিমাণ বেশি। প্রত্যক্ষ করকেই প্রগ্রেসিভ বা প্রগতিশীল কর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের কর ব্যবস্থা বহুলাংশে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বে ক্ষেত্রবিশেষে মোট আয়ের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কর আরোপিত আছে। কিন্তু আমাদের এখানে তা নেই। আমাদের দেশে ব্যক্তিশ্রেণির আয়ের ক্ষেত্রে ধনিক শ্রেণির ওপর সর্বোচ্চ কর ছিল ৩০ শতাংশ। কিন্তু দুই বছরে আগে সেটি পরিবর্তন করে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। ফলে কম আয়েল মানুষের ওপর করের বোঝা বেড়েই চলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক উচ্চ হারের মূল্যস্ফীতি। সবমিলে কর ব্যবস্থায় ধনিক শ্রেণিকেই সমর্থন দেয়া হচ্ছে।
এখনও পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট খাত থেকে। এছাড়া কাস্টমস ডিউটি থেকে এখনও বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণ হয়। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এ দুটি খাত থেকে রাজস্ব আহরণ হ্রাস পাবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আর ইচ্ছে মতো কোনো পণ্যে শুল্ক আরোপ করতে পারবে না। যখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নানা শর্ত পরিপালন করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে কোটিপতি জনগণের কাছ থেকে রাজস্ব আহরণের বিষয়ে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বলা হয়ে থাকে যে, উন্নয়নের প্রথম পর্যায়ে যে কোনো অর্থনীতিতে বৈষম্য বাড়ে। কিন্তু সেই বৈষম্য যদি দৃষ্টিকটু ও অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তাহলে তা সমাজের জন্য সুখকর হতে পারে না। কাজেই একটি ন্যায়ভিক্তিক কর ব্যবস্থা প্রবর্তনে এখন থেকেই সরকারকে তৎপর হতে হবে। সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।