প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

ক্ষুদ্রঋণের স্থান দখলে নেবে ডিজিটাল আর্থিক সেবা

পিআরআইয়ের প্রশিক্ষণে বক্তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের গ্রাম ও শহরের তুলনায় উপশহরগুলোয় বাড়ছে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি। এভাবে সারাদেশে ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবার আওতা বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে পল্লি অঞ্চলে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের আওতা সংকুচিত হয়ে আসবে এবং তাদের স্থান দখল করে নেবে বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা। তবে সুদহার বেশি হওয়া সত্ত্বেও এখনও গ্রামে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ ধার নেয়ার বিষয়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা বেশি। এর কারণ হলো কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই ঝামেলাবিহীনভাবে এখান থেকে ঋণ পাওয়া যায়। কিন্তু ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো এমন স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকবে না।

সাংবাদিকদের জন্য গতকাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় এসব কথা বলেন বক্তারা।

কর্মশালায় সভাপতিত্ব করে পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান ড. জাঈদী সাত্তার। এতে ‘এজেন্ট ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল ডিপেনিং’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। এছাড়া ‘ইউজ অব ডিএফএস অ্যামাং হাউজহোল্ডস অ্যান্ড ফার্মস’ শীর্ষক জরিপের ফল তুলে ধরেন ড. বজলুল এইচ খন্দকার। এসব উপস্থাপনায় উল্লেখিত বিষয়গুলো উঠে আসে।

জাঈদী সাত্তার বলেন, আগামী ১-২ বছরে দেশে ডিজিটাল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। সবকিছু ডিজিটাল হয়ে গেলে আগামী ৫ বছরে ক্যাশলেস সোসাইটি (নগদ লেনদেনবিহীন সমাজ ব্যবস্থা) হবে বাংলাদেশ। চীনে এখনই ৮০ শতাংশ লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে ক্যাশলেস পদ্ধতিতে। ক্যাশলেস লেনদেন হলে দুনীতি কমে আসবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক কখনও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিংবা মাথাপিছু আয় হিসাব করে না। কারণ বিবিএসের মতো এত সক্ষমতা তাদের নেই। তারা সবসময় প্রক্ষেপণ দেয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ একেবারেই হচ্ছে না, সেটি ঠিক নয়। মোট অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ভালো হচ্ছে। তবে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি চাইলে বিনিয়োগ ৩০ শতাংশ হতে হবে। এছাড়া ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি চাইলে ৩৩ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ৬/৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অনেক ভালো।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় অরিজিন হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। মানুষের বড় অংশই থাকে সেখানে। গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক অগ্রগতি ভালো হয়েছে। গ্রামে অকৃষিজ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। ফলে গ্রামে বিনিয়োগ হচ্ছে। গ্রামীণ উন্নয়নে সরকার ও এনজিও উভয়েই ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। তবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো পিছিয়ে ছিল। কেননা তাদের শাখা খুলে  ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো লাভজনক ছিল না। কিন্তু এজেন্ট ব্যাংকিং এই অবস্থার পরিবর্তন এনেছে। গ্রামের মানুষকে স্বল্প খরচে ব্যাংকিং চ্যানেলে যুক্ত করেছে। তবে এখনও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ঋণ বিতরণ বাড়েনি। সেটি আগামীতে বাড়াতে হবে। ব্যাংকের অনুপস্থিতিতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে জায়গা দখল করেছিল ক্ষুদ্র ঋণ। ২৪ শতাংশের বেশি সুদ দিয়ে সেখান থেকে মানুষ ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকের সুদের হার এর চেয়ে অনেক কম, ১০-১২ শতাংশের মতো। যে কারণে এজেন্ট ব্যাংকিং জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সারাদেশে প্রায় ২১ হাজার এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট আছে বর্তমানে।

 ২১টি ব্যাংক এ কাজ করছে। সর্বোচ্চ ৫টি ব্যাংক করছে মোট এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ৭০ শতাংশ। এগুলো হলোÑব্যাংক এশিয়া, ইসলামী ব্যাংক, ডাচ্ বাংলা ব্যাংক, সিটি এবং ব্র্যাক ব্যাংক। কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ব্যাপক রয়েছে, যা এখনও কাজে লাগানো যায়নি।

বজলুল এইচ খন্দকার বলেন, সম্প্রতি এক হাজার জনের ওপর আমরা একটি জরিপ পরিচালনা করেছি। এছাড়া ৪০০ কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে আরেকটি জরিপ পরিচালনা করা হয়েছিল। এতে দেখা যায়, গ্রামীণ পরিবার এবং কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগই ক্ষুদ্রঋণ ঋণের ওপর নির্ভরশীল। যেখান থেকে খুব বেশি ঝামেলা ছাড়াই ঋণ পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলোর সুদের হার অনেক বেশি। সুদের হার প্রায় ২৩-২৪ শতাংশ বা তার ওপরে। অন্যদিকে, অন্যান্য আনুষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক, ব্যাংক-বহির্ভূত আথিক প্রতিষ্ঠান এবং সম্প্রতি কিছু মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারীরা প্রতিষ্ঠান অনেক কম সুদে ঋণ দিচ্ছে। এ কারণে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থায়নের উৎস হিসেবে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের স্থলে ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে।

তিনি উল্লেখ করেন, জরিপে অংশ নেয়া উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৯১ শতাংশই বলেছেন, তারা ব্যবসা শুরু করেছেন নিজস্ব অর্থায়নে। আরও বলা হয়েছে ৭৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবার প্রধানের নিজস্ব মোবাইল ফোন আছে। ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ মোবাইল ফোন পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন। ১৬ দশমিক ২৩ শতাংশ বলেছেন তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। এছাড়া স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে মাত্র ২৬ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ। তবে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ৭৫ দশমিক ৩০ শতাংশ করে না। সব কিছুতে মহিলারা রয়েছে পিছিয়ে। তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়লে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে হয় সুদের হার  কমাতে হবে, না হলে বাজার থেকে ব্যবসা বাদ দিয়ে চলে যেতে হবে।