২০১৭ সালে প্রবেশের দোরগোড়ায় বাংলাদেশকে ফিরে দেখলে বলা যাবে, গত বছরের পদচারণাটা ছিল মিশ্র। আমরা আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। সবচেয়ে শক্তিশালী খাত পোশাকশিল্পের পাশাপাশি রফতানি ক্ষেত্রে অন্যান্য খাত, যেমন: পাদুকাশিল্প, ওষুধ ও আইসিটির সম্ভাবনাময় অবস্থান লক্ষ করা যায়। সড়ক ও অবকাঠামো খাতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা দেখা গেলেও বেশকিছু সফলতার নজিরও রয়েছে। যেমন ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনবিশিষ্ট মহাসড়কের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প ইতিবাচক ধারায় অগ্রসর হচ্ছে। আমরা বছর শেষ করতে চলেছি ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ খেলায় জয়লাভের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত অর্থনীতির দেশে পৌঁছানোর লক্ষ্যে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এ থেকে আমরা ছোট ও মাঝারি ব্যবসার (স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম বিজনেস বা এসএমবি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করতে পারি না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা দেশের বেশিরভাগ কর্মসংস্থানের জোগান দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের রফতানি খাত প্রধানত শিল্পনির্ভর। তাই এসএমবি খাত যতটুকু মনোযোগ পাওয়ার যোগ্য, তার চেয়ে অনেক কম মনোযোগ পেয়ে থাকে।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। ১৬০ মিলিয়ন ক্রেতার বিশাল বাজার রয়েছে এদেশে, যা বিশ্বে পঞ্চম স্থানীয়, এ আকার থাইল্যান্ডের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির মূল্য ২১০ বিলিয়ন ডলার। মধ্যম
আয়ের দেশটির সর্বনিম্ন মাথাপিছু আয়
বর্তমানে ১৩৫০ ডলার পৌঁছেছে।
বাংলাদেশের বাজার সম্পর্কে সবচেয়ে উদ্দীপনাময় দিকটি হচ্ছে, এদেশের ভোক্তা শ্রেণিটি বয়সে তরুণ। প্রযুক্তির প্রতি তাদের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে এরা পছন্দ করে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে প্রযুক্তি আত্মস্থ করে চলেছে। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে বিটিআরসি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬০ মিলিয়নের বেশি। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে প্রায় ৯৬ শতাংশ লোক। প্রায় ১২ মিলিয়ন লোক স্মার্টফোন ব্যবহার করে থাকে। সর্বোপরি বলতে হয়, মৌলিক অধিকারসহ আমরা এখন যে অবস্থানে আছি, তাতে করে দেশের বাজারই দ্রুত বর্ধনশীল ও সম্ভাবনাময়। এ বাজারে ছোট ও মাঝারি ব্যবসা অর্থাৎ এসএমবি যথেষ্ট লাভজনক হতে পারে। কিন্তু বাস্তব চিত্র তা নয়। এসএমবি খাতে আমাদের সম্ভাবনাময় দেশীয় বাজারটিকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে পারছি না।
আমাদের আঞ্চলিক পরাশক্তি চীন ও ভারতের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেখানে জাতীয় পর্যায় থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এদিক থেকে বাংলাদেশের ভূমিকা আশাব্যঞ্জক নয়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ব্রিটেন ও আমেরিকার পরেই ভারতের স্থান। ‘ফ্লিপকার্ট’ কোম্পানির কথাই ধরা যাক। ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনা করছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানির হেডকোয়ার্টার ভারতের ব্যাঙ্গালোরে। ১৫ বিলিয়ন ডলার সম্পদমূল্যের এ কোম্পানি বিশ্বের ১০টি সেরা উদ্যোক্তা কোম্পানির একটি। ই-কমার্স লজিস্টিকস, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পর্যটন, গণমাধ্যম, আর্থিক ও কাউন্সেলিংসহ বিভিন্ন খাত এ কোম্পানির অন্তর্গত।
বাংলাদেশ সরকার ইদানীং আইসিটি বা ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে উঠছে। তবু তিনটি মৌলিক সমস্যা থেকেই গেছে।
অর্থায়নের সংকট: আমাদের দেশে ৫৭টি ব্যাংক, ৩১টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এক হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা (মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউট) রয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য ঋণনির্ভর অর্থায়ন সবসময় সেরা সমাধান নয়। কেননা এতে উচ্চ হারের সুদ অথবা জামানতের প্রয়োজন হয়। এদেশে ঋণ ছাড়া বিকল্প উপায়ে অর্থায়ন একটি চ্যালেঞ্জ। নতুন কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগের শুরুতে অর্থায়ন পেলেও পরে এর সম্প্রসারণের জন্য অর্থ জোগাড় করা কঠিন হয়ে যায়। এজন্য আমাদের একটি গতিশীল শেয়ারবাজার থাকা দরকার। তাহলে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমেও অর্থায়নের আরেকটি সুযোগ থাকে।
ব্যবসায়িক পরিবেশ ও সহায়ক নেটওয়ার্ক: আমাদের দেশে এসএমবি পরিচালনার পরিবেশ একটু বেশিই অমসৃণ। এদেশে ‘লবিং’-এর ক্ষমতা অনেক সময়েই সামান্য কিছু লোকের হাতে বন্দি থাকে। সবখানেই ব্যবসা বিকাশের একটা কৃত্রিম বাধা বিরাজ করছে। এ সবকিছু ব্যবসা প্রসারের ক্ষেত্রে খরচের পরিমাণ বাড়ায়। ভারতে নতুন উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য
একশ’রও বেশি ‘বিজনেস একসিলেটরস’ (ব্যবসায়িক সেবা, ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও অফিস স্পেস প্রদানকারী সংস্থা) আছে।
আমাদের দেশে এ ধরনের উদ্যোক্তা-সহায়ক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নগণ্য।
এদেশে সম্প্রতি ঋণপ্রধান অর্থায়ন ছাড়া ‘বিজনেস একসিলেটরে’র মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা জোগাতে কিছু উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন গ্রামীণফোন ‘জিপি একসিলেটর’ প্রোগ্রাম শুরু করেছে। এ উদ্যোগের মাধ্যমে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি পাঁচজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তাকে সহায়তা দেবে। আবার আমেরিকার দারিদ্র্য দূরীকরণ সংস্থা ‘ইউএস এইড’ এগ্রো ভ্যালু চেইন (এভিসি) প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ নেটওয়ার্ক সেবা।
উদ্যোক্তা প্রতিকূল সংস্কৃতি ও সামাজিক অবস্থা: এসএমবি গড়ে তুলতে দরকার তরুণ উদ্যোক্তা, যাদের প্রতি সমাজের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা বাঞ্ছনীয়। ভারতে ৭২ শতাংশ উদ্যোক্তার বয়স ৩৫-এর কম। অথচ বাংলাদেশে নতুন উদ্যোক্তাদের প্রায়ই নিরুৎসাহিত করা হয়। সময় ও সুযোগের অপব্যবহার বলে ধরে নেওয়া হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও যথেষ্ট উদ্যোক্তা-সহায়ক নয়। এ ব্যবস্থা আরও বেশি উদ্যোগ-বান্ধব করার মাধ্যমে আমরা জনসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি। ব্যবসায়িক উদ্যোগ অন্যান্য পেশার মতোই সম্মানজনক সমাজের কাছ থেকে এই দৃষ্টি ভঙ্গি অর্জন জরুরি।
২০১৭ সালে চোখধাঁধানো নতুন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
সিইও, লাইট ক্যাসল