অনিল মো. মোমিন: কভিড মহামারির স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টার মাধ্যমে গত বছরটি শুরু হয়েছিল। কিন্তু বৈশ্বিক নানা সংকটে সেটা দুরূহ হয়ে ওঠে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলার সংকট ও আর্থিক খাতের নানা অসংগতি অস্থির করে দেয় দেশের অর্থনীতিকে। ক্রমেই এই সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। আর এই সংকটে বড় প্রভাব পড়বে খাদ্যে এবং এর ব্যাপ্তি হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। কভিডের পর এই সংকটের মূল কারণ বলা যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে। জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, ইউক্রেন বিশ্বের ৪০ কোটি মানুষের খাদ্য জোগান দিত, কিন্তু যুদ্ধরত থাকায় তারা খাদ্যশস্য রপ্তানি প্রায় পুরোটাই বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে রাশিয়া দ্বিতীয় বৃহত্তম সার রপ্তানিকারক ও বড় শস্য উৎপাদক দেশ হলেও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ববাজারে তাদের পণ্যও ঠিকমতো আসছে না। এমন নানা ধরনের সমস্যায় বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচক এবং বিশ্লেষকদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে নীরব এক দুর্ভিক্ষ বয়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সবাইকে সতর্ক থাকতে তাগিদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সবাইকে অনুরোধ করব কারও কোনো এলাকায় এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। কারণ সারাবিশ্বে এখন যে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়েছে, সেক্ষেত্রে আমি যখন জাতিসংঘে গিয়েছি, সেখানে অনেক দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। সবাই খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে, ২০২৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। আরও ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমি বলব, আমাদের দেশের মানুষকে এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। খাদ্য সংকট সবার জন্য বিপজ্জনক হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যবিত্ত, নিন্ম-মধ্যবিত্ত ও গরিব অসহায়রা। বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের যে পূর্বাভাস, তা সব দেশকে ভাবাচ্ছে। এই সংকট নিরসনে বিভিন্ন দেশ নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। কোনো কোনো দেশ আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিচ্ছে। কোনো কোনো দেশ বিশেষ বিশেষ পণ্যে রপ্তানিও সীমিত করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বলা চলে এখনও কৃষিনির্ভর। কৃষি উৎপাদনের হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর অর্থনীতির গতি-মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। অথচ দিন দিন কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অধিক জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান, রাস্তাঘাট নির্মাণ, ইটভাটা, কল-কারখানা কিংবা নগরায়ণে অধিগ্রহণের মতো নানা অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে কৃষিজমি। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে কোনো কৃষিজমি থাকবে না। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর দেশের প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজন জমির সদ্ব্যবহার। যেহেতু দেশে ফসলি জমি কম, তাই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ভাষায় এক ইঞ্চি জমিও খালি রাখা যাবে না। আমাদের অফিস, বাসা কিংবা বাড়ির মধ্যে আনাচে-কানাচে অনেক জমি রয়েছে। এসব জমি অব্যবহƒত থাকে। ঘরের চালায়, বাড়ির উঠান-আঙিনায় কিংবা বাসাবাড়ির ছাদে, এমনকি ঘরের বারান্দায়ও ফাঁকা জায়গা থাকে। শুধু বাড়ি নয়, সরকারি-বেসরকারি সব অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানার আঙিনায়ও বেশ খালি জায়গা থাকে। এসব খালি জায়গা নানা ধরনের ফুল, ফল ও সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে কাজে লাগাতে হবে।
আদর্শ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক সবজি গ্রহণের কাক্সিক্ষত মাত্রা ৩০০ গ্রাম হলেও প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ১৬৭ গ্রাম। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি উইং এবং ২০১৬-১৭ বছর অনুসারে মাথাপিছু ১২৫ গ্রাম সবজি সরবরাহ নিশ্চিত হচ্ছে। সংকটের আগে এ ধরনের পরিস্থিতি হলে সংকটকালে কী হবে, সেটা ভাবার বিষয়। আর তাই উল্লিখিত স্থানগুলোর সদ্ব্যবহার জরুরি। এসব স্থানে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা তরিতরকারি ও ফলমূল ফলানো সম্ভব। আঙিনায়, ছাদে বা বারান্দায় লালশাক, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, কলমি, বেগুন, বরবটি, গিমাকলমি, ঢ্যাঁড়শ ও করলা, লাউ, উচ্ছে, ধুন্দল, মিষ্টিকুমড়াসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি উৎপাদন করা যায়। এছাড়া বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, লেটুস পাতা, ধনে পাতা, মরিচসহ নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন মসলা, যেমনÑরসুন, তেজপাতা, ধনিয়া, মরিচ, আদা ও হলুদ উৎপাদন করা যায়। আমাদের খাদ্যতালিকায় যে জিনিসটির ঘাটতি সবচেয়ে বেশি, তা হচ্ছে ফলমূল। পুষ্টিচাহিদা পূরণে একজন মানুষের দৈনিক ১০০ গ্রাম ফল খেতে হয়। কিন্তু দেশে মাথাপিছু ফল গ্রহণের পরিমাণ মাত্র ৩৬ গ্রাম। এজন্য আমরা ওইসব স্থানে জাম্বুরা, করমচা, আতা ফল, নোনা ফল, চালতা, বেল, পেঁপে, পেয়ারা, বরই ইত্যাদি ফল গাছ লাগাতে পারি। এছাড়া আঙিনা কৃষিতে বিভিন্ন ধরনের ফুলের মধ্যে গাঁদা, চেরিফুল, জবা, টগর ও বকুল ফুলের গাছ লাগানো যায়, যা মানসিক প্রশান্তির এনে দেবে। এসব ফলমূল ও শাকসবজির উৎপাদন খরচ কম এবং লোকবল তেমন প্রয়োজন হয় না। পরিবারের সদস্যরাই অবসরে শ্রম দিতে পারেন। রাসায়নিক ও কীটনাশকের পরিবর্তে সহজে অরগানিক পদ্বতিতে উৎপাদন করা যায়। ফলে এগুলো বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। উৎপাদিত এসব ফসল পরিবারের পুষ্টিচাহিদা মেটানোর পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে আবার বিক্রি করে অর্থও উপার্জন করা যাচ্ছে। এতে বাজারনির্ভরতা কমে যায় এবং পারিবারিক সমৃদ্ধি আসে।
এমন নানা ধরনের সুবিধার জন্য ক্রমেই আঙিনা কৃষিতে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ইঞ্চি জমি ব্যবহারের বার্তাটি মানুষের মধ্যে আঙিনা কৃষির গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান বাস্তবায়নে উপজেলা কৃষি অধিদপ্তরের সহযোগিতায় অনাবাদি পতিত জমি ও বসতবাড়ির আঙিনায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রকল্প স্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতায় উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে সবজির বীজ, জৈব ও অজৈব সার, বীজ উৎপাদন, বাঁশ-খুঁটি দিয়ে সবজির বাগান তৈরিসহ যাবতীয় খরচ বহন করছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে কুষ্টিয়ার মিরপুরের কথা। মিরপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের বসতবাড়ির আঙিনায় ৪১৬টি পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হয়েছে। এই পরিবারগুলো যথেষ্ট লাভবান হয়েছেন। কৃষি অধিদপ্তরের এমন সহযোগিতায় সাড়াও মিলেছ বেশ। সুবিধাভোগী আরেকটি পরিবারের কথা বলতে পারি। ঢাকার ধামরাইয়ের ফরহাদ হোসেন। তিনি বংশী নদীর পাড়ে বসতবাড়ির উঠানে প্রায় এক বিঘা জমির ওপর পারিবারিক সবজি বাগান গড়ে তুলেছেন। বাড়ির সামনে পতিত ও অনাবাদি জমিতে মাটি ফেলে জায়গা ভরাট করে সবজি চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন তিনি। তার স্ত্রী শাহিদা বেগমও নিয়মিত সবজি বাগান দেখাশোনা করেন। নিজের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদেরও প্রায় প্রতিদিন সবজি দিয়ে থাকেন। আঙিনা কৃষির অনুপ্রেরণার আরেক নাম হতে পারে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন। তিনি তার বাসার আঙিনা ফুল, ফল আর নানা সবজিতে ভরে ফেলেছেন। তার আঙিনা দেখেই মনে হবে, এ যেন কৃষকের কোনো ভরা ক্ষেতে সোনার ফসলে ভরপুর মাঠ! শহরে জীবনেও যে আঙিনা কৃষি সম্ভব, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও ডিসকনকে বলা যায়। কৃষি সাংবাদিকতায় পুরোধা ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসনের আঙিনা কৃষির যে দৃশ্য আমাদের কাছে তুলে এনেছেন, তা নিঃসন্দেহে আমাদের শহুরে জীবনে অনন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
আঙিনা কৃষিতে স্বল্প খরচে উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূলে বিভিন্ন রকমের ভিটামিন, খনিজ লবণসহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, যেগুলো আমাদের সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত রাখার জন্য খুব বেশি দরকার। অন্যদিকে বাজারের স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ ও ভেজালযুক্ত সবজি ও ফলমূলও গ্রহণ করতে হচ্ছে না। শহর ও গ্রামে বেগবান হোক আঙিনা কৃষি এবং কাটুক খাদ্য সংকট, আসুক পারিবারিক সমৃদ্ধিÑএমনটাই প্রত্যাশা।
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়