প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

খেলাপি ঋণ রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে

সানেমের সম্মেলনে অর্থনীতিবিদরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: কভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ বেড়েছে। এক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি, ব্যাংক খাতে সংস্কার এবং আর্থিক খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাসহ অর্থনীতিতে ১০ ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব মোকাবিলায় ব্যাপক সংস্কারসহ আইএমএফের শর্তের কার্যকর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তবে সংস্কারের খড়্গ যাতে কেবল নিন্ম ও মধ্যবিত্তের ওপর না আসে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো সহজ বিষয় নয়, এটি কমানো রাজনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু কাগজে সই করলেই কি খেলাপি ঋণ কমে যাবে?

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সšে§লনে আলোচনায় অংশ নিয়ে দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা এসব কথা বলেন। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল দুদিনের সম্মোলনের প্রথম দিনের বিভিন্ন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিনের অধিবেশনগুলোয় দেশি-বিদেশি প্রায় ৪০টির মতো গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। সম্মেলনের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘বিল্ডিং রেজিলিয়েন্স টু শকস: প্রাইরেটিস, চ্যালেঞ্জ অ্যান্ড প্রসপেক্টস।’

সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। সানেমের চেয়ারম্যান ড. বজলুল হক খন্দকারের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।  এ পর্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। অপর একটি অধিবেশনে ড. সেলিম  রায়হানের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান এবং অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

সম্মেলনে তুলে ধরা অন্য চ্যালেঞ্জগুলো হলো প্রবৃদ্ধি অর্জনের নতুন পথ বের করা, রপ্তানি পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ, খেলাপি ঋণ কমানো, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সংস্কার এবং জিডিপির তুলনায় করহার বাড়ানো। আরও আছে সময়মতো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. শামসুল আলম বলেন, আইএমএফ আমাদের কোনো শর্ত দেয়নি। তারা বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে। যেসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে সেগুলো যৌক্তিক। তবে সংস্কার তো রাতারাতি সম্ভব নয়। সংস্কার হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। সংস্কার যন্ত্রণাদায়ক হলেও এরই মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সেটি  করায় আইএমএফ আমাদের ঋণ দিয়েছে। চলমান সংস্কারের কারণে দেশে দারিদ্র্য বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তার কারণ হলো গ্রামীণ এলাকায় বেকারত্ব নেই। কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, আইএমএফ ঋণ দেয়ায় অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও ঋণ দিতে উৎসাহ পাচ্ছে। এরই মধ্যে এআইআইবি বাজেট সহায়তা দিয়েছে। আরও আড়াই বিলিয়ন ডলার দেবে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি ভালো হচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, ঋণ গ্রহণের হার, বিদ্যুৎ সুবিধা, নারীদের কর্মে নিযুক্তি, গড় আয়ু, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু রোধ এবং মানব উন্নয়ন সূচকে অনেক ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর  তুলনায় ভালো অবস্থানে আছি আমরা। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে তুলামূলকভাবে রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। কাজেই আমাদের রিজার্ভ আর পড়বে না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক দেশেই ভিন্ন ডলার রেট আছে। তাই প্রবাসীদের জন্য আমাদের দেশে ডলার রেট কিছুটা বেশিই থাকবে। তিনি আরও বলেন, রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতেই আছে। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়মিত হচ্ছে।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, সরকারি নীতিই অনেক সময় মানুষকে দরিদ্র করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এর একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে ব্যাংক খাত। এ খাতে লাখ লাখ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে আর গুটিকয়েক মানুষ ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে যান। সেগুলো আর ফেরত আসে না। সরকারি নীতিতে আবার দুই শতাংশ দিয়ে পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেয়া হয়। এতে খেলাপি ঋণ উৎসাহিত হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আদানী গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের যে চুক্তি আছে, সেটি স্মার্ট চুক্তি হয়নি। এ চুক্তি সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, রপ্তানি শুধু পোশাক খাতনির্ভর। এখানে বহুমুখীকরণ করতে হবে। মানবসম্পদ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আদম ব্যবসায়ীদের কারণে অভিবাসন খরচ বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা দেশে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। দেশে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রয়োজন। আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য শুধু ভালো ভালো নীতিমালা করলেই হবে না, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ভালো সরকার। সরকার এখন দেশকে স্মার্ট করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সু®ু¤ পরিকল্পনা। তিনি বলেন, ভাবা হচ্ছে কভিড ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দেশের প্রেক্ষাপটে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আসলে এই সমস্যাগুলো দীর্ঘদিনের। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কারণে তা আমাদের অর্থনীতিতে বেশি প্রভাব ফেলছে।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বড় কথা নয়, বরং দেখতে হবে, প্রবণতা কী? রিজার্ভের প্রবণতা নিচের দিকে নামতে থাকলে ঠেকানো কঠিন। দেশের রিজার্ভ একসময় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারও ছিল। তাই বলছি, পরিমাণ অনেক সময় বড় সমস্যা নয়, প্রবণতাটাই বড় কথা। আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিতে অনেক শর্তের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানোর কথাও আছে। আইএমএফ বলেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা পাঁচ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু খেলাপি ঋণ অনেক দশক ধরে দেখেছি, শুধু কাগজে সই করলেই কি খেলাপি ঋণ কমে যাবে? এটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ব্যাপার। খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত দেয়ার মাধ্যমে আইএমএফের আমলাতন্ত্র খুশি, আমরাও খুশি। তিনি বলেন, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দুই শতাংশের বেশি উল্লেখ করে বেসরকারি খাতে শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি সজ্জন ব্যক্তি। কিন্তু শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি ব্যয়ের বিকল্প নেই, বেসরকারি খাত থাকবে পরিপূরক হিসেবে। শিক্ষায় সরকারি ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এখন সমান।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানির চাপ বাড়ায় রিজার্ভ কমছে। এখনও এলসি খোলায় সমস্যা হচ্ছে। ছয় মাস ধরে ডলার সংকট চলছে। আমদানি বিল পরিশোধ সময়মতো করা যাচ্ছে না। ফলে দেনা বাড়ছে। তবে  আইএমএফের ঋণ বড় কিছু না হলেও অন্যদের কাছে ঋণ পেতে সহায়ক হবে। হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সামষ্টিক খাতে যে শক এসেছে তা বাস্তবতা। বর্তমান পরিস্থিতিতে পুষ্টি কম পাচ্ছে মানুষ। জীবনমানের অনেক কিছুর সঙ্গেই আপস করতে হচ্ছে। কভিডে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সচেতনতার ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে, তা অনেক বড় ক্ষতি। দুই বছরের ক্ষতি প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। জাহিদ হোসেন বলেন, আইএমএফের ঋণের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না, অন্য সূত্র থেকেও ঋণ পেতে হবে। আর্থিক খাতে সংস্কারে সাহসী ভূমিকা নিতে হবে। আসলে সরকার চালাচ্ছে কে, এটিই এখন বড় প্রশ্নÑরাজনীতিবিদেরা না আমলাতন্ত্র? সংসদের মধ্যেও অনেক সংসদ সদস্যকে এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। আসলে রজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। মোস্তাজিুর রহমান বলেন, সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অন্যতম চ্যালেঞ্জ। রপ্তানি পণ্য পোশাক খাতের পাশাপাশি ওষুধ ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংসহ অন্য খাতের দিকে যেতে হবে। দিনের অন্য অধিবেশনগুলোয় বক্তব্য দেন ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফা কে মুজেরী, বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. মঞ্জুর হোসেন, সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা প্রমুখ। আজ রোববার বিভিন্ন অধিবেশনে আরও প্রায় ৪০টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে।