নাজমুস সাকিব: আবহমানকাল ধরেই মানুষ সৌন্দর্যপিয়াসী। এই সৌন্দর্য বাড়াতে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের অপরিহার্য অনুষঙ্গ অলংকার বা গহনা। স্থান কাল আর যুগের চাহিদায় পরিবর্তন এলেও সৌন্দর্যচর্চায় গহনার আবেদন শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়েই চলমান। প্রাচীনকালে ফুল, পাখির পালক আর সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবান পাথর, পরবর্তী সময়ে মুক্তা, সোনা, রুপাসহ ধাতব পদার্থেও শোভা বাড়িয়েছে নারী-পুরুষ। বর্তমান সময়ে ডায়মন্ডের চাহিদা বাড়লেও বেশিরভাগ মানুষের চাহিদার শীর্ষে সোনা, রুপাসহ ধাতব অলংকার।
আকাশছোঁয়া দামের কারণে মধ্যবিত্ত আর নিম্ন বিত্তের কাছে স্বর্ণের গহনা দিন দিন দুষ্প্রাপ্য হচ্ছে। তাছাড়া স্বর্ণের অলংকার ছিনতাইকারী আর ডাকাতের টার্গেট হওয়ায় সেটি নিরাপদ নয়। তাই বিকল্প খোঁজেন অনেকেই। ফলে বাড়ছে রুপা-তামাসহ ধাতব অলংকারের চাহিদা। এই চাহিদার জোগান দিতেই আর্থসামাজিক চিত্র পাল্টে দেওয়া এক গল্পের জন্ম দিয়েছে সাভারের ভাকুর্তা এলাকা।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার পেরোলেই চোখে পড়বে তুরাগ নদের ওপর ছোট্ট একটি লোহার সেতু। সেখান থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার গেলেই সাভারের একটি ইউনিয়ন ভাকুর্তা।
রাস্তার পাশে অজস দোকান, যেখানে দিনরাত চলছে গহনা তৈরির কাজ। রুপা ও তামাসহ ধাতব দ্রব্যের মিশেলে তৈরি হচ্ছে নান্দনিক সব গহনা। ছোট ছোট উপাদান, একটার সঙ্গে আরেকটার যেন মানিকজোড়। কারিগরের নিপুণ হাতে দৃষ্টিনন্দন নকশা আর আকৃতিতে তৈরি হচ্ছে নারীদের হাতের চুড়ি, গলার মালা, মাথার টায়রা কিংবা তাজ। গহনা তৈরির উপাদান হিসেবে ভাকুর্তার কারিগররা বেছে নিয়েছেন রুপা, তামাসহ অপেক্ষাকৃত কম খরচের উপাদান। ধাতব পদার্থ থেকে মেশিনের সাহায্যে ছোট ছোট আকৃতিতে নকশা করে কেটে নেওয়া হয়। নকশা আর উপাদানসামগ্রী যায় কারিগরের কাছে। অপরিসীম ধৈর্যে একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ ঘটিয়ে তা নান্দনিক গহনায় রুপ দেন কারিগর।
এসব কাঁচামালের বেশিরভাগই আসে দেশের বাইরে থেকে। এই দৃশ্যের দেখা মিলবে চুনারচর, ডোমরাকান্দা, সোলার মার্কেট, খাগুড়িয়া, নলাগুড়িয়া, হিন্দুভাকুর্তাসহ এ ইউনিয়নের ৩৬টি গ্রামে। কম দামে, সাধারণ মানুষের সাধ আর সাধ্যের মিলন ঘটিয়ে গহনা তৈরির জন্য এই এলাকার আরেক নাম এখন গহনার গ্রাম।
পেশাগত কারণে খুব নিবিড়ভাবে ভাকুর্তা গ্রাম দেখার সুযোগ হয়েছে। এখানকার গহনা কয়েক ধাপ পেরিয়ে বিক্রি হয় রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি, নিউমার্কেট, মৌচাক, চাঁদনী চকসহ অভিজাত বিপণি বিতানে। দীর্ঘদিন গহনা তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত এই এলাকার মানুষ। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, এখানকার গহনার চাহিদা দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও।
শুধু পুরুষ নয়, পাশাপাশি সমানতালে কাজ করেন নারীরাও। এমনি একজন মঞ্জু রানী দত্ত। সম্পদ বলতে নেই তেমন কিছু। অভাবের সংসারে স্বামী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন যেন গহনা তৈরির কাজ। আবার অনেকেই সংসারে বাড়তি আয় যোগ করতে ঘরের কাজ সেরে বসে যান শিকল গাঁথার কাজে। এ এলাকার প্রায় সব পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি এ কাজের সঙ্গে যুক্ত নারীরা। ভাকুর্তা ইউনিয়নে ছয় থেকে প্রায় আট হাজার মানুষ গহনা তৈরির কাজ করেন।
পাইকারদের চাহিদা অনুসারে কাজ করেন এখানকার কারিগর আর ব্যবসায়ীরা। দুই শতাধিক দোকানে দৈনিক বেচাবিক্রিও কম নয়। গহনা তৈরির এই বাজার থেকে মাসে অন্তত কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়। অন্য পেশার চেয়ে তুলনামূলক আয় বেশি। তাই কারিগর, ব্যবসায়ী কিংবা শ্রমিক সবার কাছেই সমাদৃত এই কাজ। নারী কিংবা পুরুষ, হিন্দু কিংবা মুসলমান, নির্বিশেষে সবার জন্যই দু-মুঠো অন্নের জোগান দিয়ে চলেছে গহনা।
শুধু স্থানীয় লোকজনই নয়, এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্য জেলার বাসিন্দারাও। তারাও নিরলসভাবে কাজ করছেন এখানে। তবে ব্যাংকিং সুবিধা না থাকা, প্রয়োজনীয় এসিড বহনে প্রশাসনিক ঝামেলা প্রায়ই ভোগান্তিতে ফেলে ব্যবসায়ীদের। এখানে তৈরি হওয়া এসব গহনা ক্রেতাদের হাতে পৌঁছানোর আগে যায় কারখানায়। ভাকুর্তায় তৈরির পর সেটা যায় নকশাকারের কাছে। পানি এবং রাসায়নিক দ্রবণে ধুয়ে তাতে নকশা কাটা হয়। বাহারি নকশায় গহনাটিকে দেওয়া হয় নান্দনিক রূপ। নকশার কাজ শেষ হলে রঙ করার আগে আরেক দফা রাসায়নিক দ্রবণে পরিষ্কার রঙ করার উপযোগী করা হয়। এরপর তা ডোবানো হয় গোল্ড প্লেটেড রঙে। উচ্চতাপে মুহূর্তে গহনাটি ধারণ করে স্বর্ণালি রুপ। কখনো কখনো ক্রেতার চাহিদা অনুসারে সেটি সিলভার বা অন্য রঙও দিয়ে দেন কারিগররা। রঙের কাজ শেষ। কাঁচামাল থেকে গহনার পূর্ণাঙ্গ রূপ। কয়েক ধাপে বেশ কয়েকজন কারিগরের হাত ঘুরে এবার গহনাটি উঠে আসে শোরুমে। ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে পছন্দের নকশায়, পছন্দের গহনাটি কিনে নেন সাধ্যের সীমানায়। উচ্চমূল্যের স্বর্ণের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় সেই চাহিদা। চাহিদা হবেই বা না কেন? সাধ তো সবারই। ক’জনই সামর্থ্য রাখে সাধের গহনার জন্য এত খরচের! একটু উদ্যোগ আর সরকারের সহায়তায় পাল্টে যেতে পারে এই এলাকা। বেকারত্ব সমস্যার সমাধানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ভাকুর্তার গহনা গ্রাম। তাই ব্যাংকিং সুবিধাসহ সরকারি সহায়তা চান ব্যবসায়ী নেতারা। চান কাঁচামাল সরবরাহে হয়রানি থেকে মুক্তি।