নিজস্ব প্রতিবেদক: গণশুনানি উপেক্ষা করেই গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ল আরেক দফা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন অধ্যাদেশ ২০২২-এর আওতায় এ ঘোষণা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এবার গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে প্রায় ৩৬ পয়সা বা পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রতি ইউনিটের দাম ৭ টাকা ১৩ পয়সা থেকে বেড়ে হলো ৭ টাকা ৪৯ পয়সা। চলতি মাস থেকেই নতুন দাম কার্যকর হচ্ছে।
গতকাল দাম বৃদ্ধির এ প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ বিভাগ। গত ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) অধ্যাদেশ সংশোধনের কারণে বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষমতা পায় সরকার। ওই অধ্যাদেশের আওতায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হলো। বিইআরসির গণশুনানি উপেক্ষা করে এ ঘোষণা দেয়া হলো। ২০০৭ সালের পর এবারই সরাসরি দাম বাড়াল বিদ্যুৎ বিভাগ।
এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ায় সরকার; যা ওই বছর মার্চ থেকে কার্যকর হয়। আরেক দফা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গত ৮ জানুয়ারি গণশুনানি হয়। শুনানিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটি ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিল। আইন অনুযায়ী শুনানির ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়ার কথা। তবে বিইআরসির ঘোষণার জন্য অপেক্ষা না করেই নতুন দাম ঘোষণা করল বিদ্যুৎ বিভাগ।
প্রজ্ঞাপনের তথ্যমতে, আবাসিকের লাইফ লাইন গ্রাহকদের (শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা। আর সাধারণ গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ১৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৪০ পয়সা, দ্বিতীয় ধাপে ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের জন্য ৫ টাকা ৭২ থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ০১ পয়সা, তৃতীয় ধাপে ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৩০ পয়সা, চতুর্থ ধাপে ৩০১ থেকে ৪০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৩৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬৬ পয়সা, পঞ্চম ধাপে ৪০১ থেকে ৬০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৯ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৪৪ পয়সা এবং ষষ্ঠ ধাপে ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ০৩ পয়সা করা হয়েছে।
এর বাইরে গ্রাহক পর্যায়ে ডিমান্ড চার্জও বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে আবাসিক গ্রাহক ও সেচ গ্রাহকদের ১৭ শতাংশ, শিল্প (ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ) গ্রাহকদের ২৫ শতাংশ এবং শিক্ষা, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালে ৪২ শতাংশ ডিমান্ড চার্জ বাড়ানো হয়েছে।
আবাসিকের বাইরে কৃষিকাজে বা সেচে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা ১৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৩৭ পয়সা করা হয়েছে। আর ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের দাম অফপিক ৭ টাকা ৬৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ০৬ পয়সা, পিক সময়ে ১০ টাকা ২৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৭৫ পয়সা, আর ফ্লাট রেটের ক্ষেত্রে ৮ টাকা ৫৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৯৬ পয়সা করা হয়েছে।
এদিকে শিল্প খাতে মধ্যম চাপ (১১ কেভি) বিদ্যুতের দাম ফ্ল্যাট রেট ৮ টাকা ৫৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৯৮ পয়সা, অফপিক সময়ে ৭ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ০৯ পয়সা, আর পিক সময়ের ক্ষেত্রে ১০ টাকা ৬৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ২২ পয়সা করা হয়েছে। একইভাবে উচ্চচাপ (৩৩ কেভি) ও অতি উচ্চচাপ (১৩২ কেভি ও ২৩০ কেভি) গ্রাহকদের বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে।
অন্যান্য খাতের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট রেট ১০ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৯২ পয়সা, অফপিক সময়ে ৯ টাকা ২৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৭৩ পয়সা এবং পিক সময়ের জন্য ১২ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৯৮ পয়সা করা হয়েছে। আর ব্যাটারি স্টেশনে চার্জিংয়ের ক্ষেত্রে অফপিক সময়ের জন্য ৬ টাকা ৮৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ২২ পয়সা, সুপার অফপিক সময়ের জন্য ৬ টাকা ১১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৪২ পয়সা, পিক সময়ের জন্য ৯ টাকা ৫৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ০৩ পয়সা এবং ফ্ল্যাট রেটে ৭ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে ৮ টাকা ০২ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০১০ সালের মার্চ থেকে এ নিয়ে ১০ম বার বাড়ানো হলো গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে ২০১০ সালের মার্চে প্রথম বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৯২ পয়সা। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহক পর্যায়ে দুই দফা বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ানো হয় ৫ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ টাকা ৬৭ পয়সা।
২০১২ সালেও খুচরা বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানো হয়। এর মধ্যে মার্চে বাড়ে ৭ দশমিক ০৯ শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে ১৫ শতাংশ। এতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের গড় মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। এরপর ২০১৪ সালের মার্চে বিদ্যুতের দাম ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় ৬ টাকা ১৫ পয়সা। আর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তা ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়ে হয় ৬ টাকা ৩৩ পয়সা।
এদিকে ২০১৭ সালে ডিসেম্বরে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ৬ টাকা ৮৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ওইবারই প্রথম বিদ্যুৎ বিতরণকারী সব কোম্পানির জন্য অভিন্ন মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। এতে ঢাকার চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের দাম বেশি হারে বাড়ে। এর প্রভাবে গড় মূল্যহার কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল গড়ে ৬ টাকা ৭৭ পয়সা। আর ২০২০ সালের মার্চে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে গড় মূল্যহার দাঁড়ায় ৭ টাকা ১৩ পয়সা।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ৪৯ পয়সা। অর্থাৎ ১৩ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৩ টাকা ৭৫ পয়সা বা ১০০ দশমিক ৮০ শতাংশ।