নাজমুল ইসলাম ফারুক: আলকাতরার চাহিদা কমছে। তাই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কেঅ্যান্ডকিউ লিমিটেড ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করেছে উৎপাদন। বিক্রি করে দিয়েছে কারখানার যন্ত্রপাতি। এরপর সিএনজি ব্যবসাও বন্ধ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। চার মাস ধরে সিএনজি স্টেশনটি বন্ধ থাকলেও ঘোষণা দেয়নি কেঅ্যান্ডকিউ। এমন একটি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপন করা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।
রাজধানীর সন্নিকটে ধামরাই কে অ্যান্ড কিউ কারখানাটিতে গিয়ে দেখা গেছে, গেটের পাশেই সিএনজি স্টেশন। কয়েকটি গাড়ি স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সিএনজি স্টেশনে ভেতরের দিকে এগোতেই দেখা যায়, পলিথিনে মোড়ানো রয়েছে অকটেন, ডিজেল ও সিএনজি মেশিনগুলো।
স্টেশনটিতে পাহারারত শ্রমিকরা জানান, সিএনজি স্টেশনটি চার মাস ধরে বন্ধ রয়েছে।
কী কারণে সিএনজি স্টেশনটি বন্ধ জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারখানার ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন লোকসানে রয়েছে কেঅ্যান্ডকিউ। আয়ের একমাত্র শেষ ভরসা ছিল সিএনজি স্টেশন। কিন্তু পাওনা সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় হঠাৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তিতাস গ্যাস।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, নিয়মানুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানানো হয়। যদি কোনো কোম্পানি তা না করে, তাহলে ওই কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করলো। তবে এসব বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
কারখানার ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায় বিশাল মাঠ, শুধু যন্ত্রপাতিই নয়। কারখানার ইট-পাথরও খুলে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান কর্তব্যরতরা।
কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, আগে কারখানার মালিক আবদুল আউয়াল মিন্টু মাসে কয়েকবার আসতেন। পরবর্তী সময় তার ছেলেরা এলেও গত এক বছর তার পরিবারের কারও কারখানায় যাতায়াত নেই।
দুই যুগের বেশি সময় কাজ করেন এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, একসময় কার্বন রডের বেশ চাহিদা ছিল। সে সঙ্গে আলকাতরারও। কার্বন রড ও আলকাতরার জন্য ট্রাক লরি এসে সিরিয়াল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যবসায় মন্দায় পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে কারখানার উৎপাদন বন্ধসহ যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দেওয়া হয়।
তথ্যমতে, চলতি বছর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা দেয় কে অ্যান্ড কিউ। এতে বলা হয়, পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে বিনিয়োগ বোর্ডকে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে আইআরসি, ইআরসি, টিন, ই-টিন, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স, কারখানার সনদ, কারখানার নিবন্ধন, ফায়ার সুরক্ষা সনদ, পরিবেশ সনদ ইত্যাদি বাতিল এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনীর জন্য আমদানি-রফতানি বিভাগের প্রধান নিয়ন্ত্রক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর ও ভ্যাট বিভাগে আবেদন জমা
দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বন্ধ কার্বন রড ইউনিট (ইউনিট-১) এবং আলকাতরা ইউনিটের (ইউনিট-২) অব্যবহৃত কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতিও বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় পর্ষদ। কিন্তু প্রায় চার মাস ধরে সিএনজি স্টেশনটি বন্ধ রয়েছে, যা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য।
শুধু যন্ত্রপাতি বিক্রি নয় কারখানার প্রাঙ্গণের এক লাখ ১৪ হাজার বর্গফুট জমি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। যার প্রতি বর্গফুটের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে আট টাকা। সে সঙ্গে কারখানার অফিস বিল্ডিং সিজি ফুডের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। যার প্রতি বর্গফুটের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ টাকা। আর ভাড়ার চুক্তি ১৫ বছরের জন্য করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি তিন বছর পর পর ভাড়া বাড়ানো হবে। যার মধ্যে সর্বশেষ তিন বছর জমির ভাড়া প্রতিবর্গফুট ১২ টাকা ৮০ পয়সা এবং বিল্ডিংয়ের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯ টাকা ২০ পয়সা।
কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ইফতেখার উদ্দিনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি অফিসে যেতে বলেন। অফিসে গিয়ে একাধিক দিন যোগাযোগ করলে তিনি মিটিংয়ের ব্যস্ততার অজুহাতে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
তবে কোম্পানির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, যন্ত্রপাতি অনেক পুরোনো হয়ে যাওয়ার বেশিরভাগই অচল হয়ে গেছে। তাই যন্ত্রপাতি এক বছর আগেই বিক্রি করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া কোম্পানিটি লোকসানে থাকায় সিএনজি স্টেশনটি উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ছিল। কিন্তু যে কোনো কারণেই স্টেশনটি বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে সব ধরনের ব্যবসা বন্ধ থাকার পরও কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ছে। কোম্পানির লেনদেন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ২২ নভেম্বর কোম্পানির শেয়ারদর ছিল ২৬ টাকা ২০ পয়সা, যা গত বৃহস্পতিবার কোম্পানির শেয়ার সর্বশেষ ৩১ টাকা ৮০ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে। কোম্পানির সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ থাকার পরও ১৩ কার্যদিবসে পাঁচ দিন বেড়েছে কোম্পানির শেয়ারদর। এ সময়ে কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে পাঁচ টাকা ৬০ পয়সা। এছাড়া কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে বলে পরিচালনা পর্ষদ যখন গত মে মাসে ঘোষণা দেয় তার পরেও শেয়ারদরে উল্লম্ফন দেখা দেয়। ওই সময় কোম্পানির শেয়ারদর ছিল ১৭ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বেড়ে ২৮ টাকাও বেচাকেনা হয়েছে।
চলতি বছর এপ্রিল মাসের পর থেকে এ পর্যন্ত কোম্পানিকে শেয়ারদর বাড়ার বিষয়ে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য জানতে একাধিকবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ নোটিস দিয়েছে। প্রতিবারই দর বাড়ার কারণ নেই বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একদিকে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ও পরিচালকদের শেয়ার ধারণে ব্যর্থ তবুও শেয়ারদর বাড়ছে। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার আগে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকদের।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সাবেক সভাপতি আবদুল আওয়াল মিন্টুর মালিকাধীন মাল্টিমুড গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান কে অ্যান্ড কিউ। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, প্রায় ২০ বছর সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে কে অ্যান্ড কিউ। ড্রাইসেল ব্যাটারির কার্বন রড ও আলকাতরা প্রস্তুত করতো প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি ব্যবসা ডাইভারসিফাইট করে সিএনজি স্টেশন ছাড়াও সালফারসহ অন্যান্য প্রসেসিং এবং প্যাকেজিং করা হচ্ছে।
সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিষ্ঠানটির প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত ) হিসাব অনুযায়ী, শেয়ারপ্রতি লোকসানে হয়েছে ৩৫ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে লোকসানের পরিমাণ ছিল ২৬ পয়সা। এছাড়া গত ৩০ জুন সমাপ্ত ১৮ মাসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে দুই পয়সা, শেয়ারপ্রতি সম্পদ লোকসানের পরিমাণ ১১ টাকা ৪৯ পয়সা।
লভ্যাংশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোম্পানিটি ২০০৭ সালে ১০ শতাংশ বোনাস, ২০০৮ থেকে ২০১০ সালে পাঁচ শতাংশ বোনাস এবং ২০১১ সালে পাঁচ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। কিন্তু ২০১২ সালে থেকে চলতি বছর পর্যন্ত কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করছে। কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ চার কোটি ১৫ লাখ টাকা।
এদিকে পরিচালদের শেয়ার ধারণের সীমাও মানছে না প্রতিষ্ঠানটি। ডিএসইর তথ্যানুযায়ী, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কোম্পানির মোট শেয়ারের মধ্যে পরিচালকদের কাছে রয়েছে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অথচ তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করার নিয়ম রয়েছে। মোট শেয়ারের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৭২ দশমিক ১০ শতাংশ শেয়ার।