নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘চট্টগ্রাম-দোহাজারি মিটারগেজ রেলপথকে ডুয়েলগেজ রেলপথে রূপান্তর’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ৩০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ (রেলের ইঞ্জিন) কেনার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির প্রমাণ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ের তিন সদস্যের এনফোর্সমেন্ট টিমের এক অভিযানে এমন প্রমাণ উঠে এসেছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, অভিযানের সময় প্রাপ্ত তথ্য ও নথিপত্র পর্যালোচনায় প্রকল্পের স্পেসিফিকেশন অনুপস্থিতি ও প্রাক্কলন প্রক্রিয়ায় অস্পষ্টতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির আশঙ্কার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক টিম। অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে প্রকৃত অবস্থা উদ্ঘাটন করে কমিশনে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে টিম।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ‘চট্টগ্রাম-দোহাজারি মিটারগেজ রেলপথকে ডুয়েলগেজ রেলপথে রূপান্তর’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ৩০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ ক্রয় প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের প্রচেষ্টার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানের সময় প্রাপ্ত তথ্য ও নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ প্রকল্পের মূল ডিপিপিতে ৩০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ ক্রয়ের কোনো নির্দিষ্ট প্রাযুক্তিক স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করা হয়নি। বরং এটি উল্লেখ ছাড়াই লোকোমোটিভ, ক্যাপিটাল স্পেয়ার এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সামগ্রীসহ বিল অব কোয়ানটিটিজের (বিওকিউ) ভিত্তিতে ক্রয় প্রাক্কলন নির্ধারণ করা হয় প্রায় ২ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালে একনেকে অনুমোদিত হয়। স্পেসিফিকেশন অনুপস্থিতি ও প্রাক্কলন প্রক্রিয়ায় অস্পষ্টতা প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম, অস্বচ্ছতা এবং দুর্নীতির সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয় বলে এনফোর্সমেন্ট টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
অন্যদিকে দুদকের দাখিল হওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, এর আগেও ৩০টি নিম্নমানের মিটারগেজ লোকোমোটিভ ক্রয়ের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা গচ্চা দেয়া হয়েছিল। ওই ইঞ্জিনগুলোর অধিকাংশই এখন অকেজো, যার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ছিল হুন্দাই রোটেম নামে একটি বিদেশি কোম্পানি। এবারও এডিপির ঋণে আরও ৩০ ইঞ্জিন আনা হচ্ছে। তার ওপর ইঞ্জিনপ্রতি বাজেট বাড়িয়ে ৩২ কোটি থেকে ৮০ কোটি টাকা করা হয়েছে। বিগত সরকারের সময়ে পাস হওয়া প্রকল্পের নথিপত্রে কৌশলে ইঞ্জিনের স্পেসিকেশন ঘর ফাঁকা রাখা হয়েছিল। একনেকে পাস হওয়া ওই প্রকল্পই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ডিপিপিতে গোপনে ফাঁকা জায়গায় নতুন শর্ত যোগ করে আগের কোম্পানি হুন্দাই রোটেমকে কাজ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, আগের দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের অন্যতম একজনকে তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে যোগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে গত ১০ আগস্ট বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ৩০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ ক্রয়ের জন্য প্রস্তুত করা খসড়া স্পেসিফিকেশন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) ড. শেখ মইনউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি করা হয়। ক্রয় কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। ক্রয় কার্যক্রম সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক আলোচনার পর উš§ুক্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ টেন্ডার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে ওই কমিটি গঠন করা হয় বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম দোহাজারী রেলপথ ডুয়েলগেজ করা হচ্ছে। কিছুটা আলোচিত এবং সমালোচিত হলেও প্রকল্পটি গতকাল একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলসংযোগ নির্ঝঞ্ঝাট করতে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত বিদ্যমান পুরোনো মিটারগেজ রেলপথটিকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের এই প্রকল্পের ব্যয় করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রায় ১০৩ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়। প্রকল্পটিতে রেললাইনের বাইরেও ২৪টি মেজর ও ৯৫টি মাইনর সেতু পুর্ননির্মাণ করতে হয়। সেতু নির্মাণ ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। রড-সিমেন্ট এবং শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় এসব ক্ষেত্রেও ব্যয় আগের তুলনায় বেশি। এছাড়া প্রকল্পটির আওতায় দুটি রেলস্টেশন নতুন করে নির্মাণের কারণে খরচ বেড়েছে। তাছাড়া প্রকল্পের মূল কাজ ১০৭ কিলোমিটার ট্র্যাক ডুয়েলগেজে রূপান্তর করতেও বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়।
সূত্র বলেছে, প্রকল্পটির জমি অধিগ্রহণ ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৪২৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। প্রকল্পের মূল কাজ অর্থাৎ রেল ট্র্যাক নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭৫৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। প্রকল্পের মাটি ভরাট খাতে ১ হাজার ৭২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। প্রকল্পের আওতায় স্টেশন ও ভবন নির্মাণে ৭১১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণে ১ হাজার ৩১৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, সিগন্যালিং ও টেলিকমে ৩০৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা এবং প্ল্যান্ট ও ইক্যুইপমেন্টে ৩০৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর বাইরে পরামর্শক খাতে ৫৮৮ কোটি টাকা খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post