রহমত রহমান: আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে চমক নেই। মাথাপিছু আয় আর মূল্যস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই করজাল সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। নেয়া হয়েছে করদাতাদের স্বস্তি দিতে নতুন উদ্যোগ। রাজস্ব আদায় অনলাইননির্ভর করতে থাকতে পারে নির্দেশনা। দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষায় করছাড় অব্যাহত থাকতে পারে। বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে কর অবকাশ চলমান থাকতে পারে। অব্যাহতির ক্ষেত্র সংকুচিত করা হতে পারে। নতুন কর আইন নিয়ে থাকতে পারে সুখবর। বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নাও থাকতে পারে। পুঁজিবাজারে করছাড়ে থাকতে পারে তদারকির বিষয়ে নির্দেশনা। কর ও ভ্যাট আদায়ে থাকবে এজেন্ট নিয়োগ বিষয়ে থাকতে পারে নির্দেশনা। রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিধান পালনে কঠোরতা আসতে পারে।
বিদ্যুৎ মিটারধারীদের করের আওতায় আনার উদ্যোগ থাকবে। প্রতিটি বাড়ি ও ফ্ল্যাট মালিককে করের আওতায় আনতে হোল্ডিং নাম্বার বিষয়ে নির্দেশনা থাকতে পারে। কর ফাঁকি রোধে শূন্য রিটার্নে কর আদায়ে থাকছে নির্দেশনা। আয়কর ও ভ্যাট রিটার্ন দাখিল বাড়াতে থাকতে পারে নির্দেশনা। মোট কথা, আগামী বাজেটে কেবল করজাল বাড়ানো বা কর আদায় বাড়ানোর বিষয়ে থাকতে পারে একগুচ্ছ উদ্যোগ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা করা হতে পারে। আগামী ১ জুন সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট ঘোষণা করবেন। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সূত্রমতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ অনুসারে রাজস্ব খাত সংস্কার করতে হবে। বাড়াতে হবে রাজস্ব আদায়
ও কর জিডিপি। শর্তের মধ্যে অন্যতম একটি হলো আগামী অর্থবছরে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির অতিরিক্ত শুল্ককর আদায় করা। অর্থাৎ বাড়তি ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। সে শর্ত মেনে এনবিআর আগামী বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়ানো ও রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। সে জন্য বাজেটে নির্দেশনা থাকবে। সদ্য অনুমোদিত নতুন কর অঞ্চল কবে নাগাদ চালু করা হবেÑ সে বিষয়ে নির্দেশনা থাকতে পারে। নতুন কর অঞ্চল চালু হলে করদাতার সংখ্যা ও কর আদায় বাড়বে। নতুন ভ্যাট কমিশনারেট ও কাস্টম হাউস অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে, সে বিষয়েও নির্দেশনা থাকতে পারে। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের বড় হাতিয়ার হলো ভ্যাট। বর্তমানে ১২টি ভ্যাট কমিশনারেট রয়েছে। গত এক দশকেও ভ্যাট কমিশনারেট বাড়ানো হয়নি। এই এক দশকে দেশে ব্যবসা ও ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। নতুন কমিশনারেট করা হলেও ভ্যাট আহরণ বাড়বে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।
বাজেটে ভ্যাট বিষয়ে যেসব নির্দেশনা ও উদ্যোগ থাকতে পারে
এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, আগামী বাজেটে ভ্যাট আদায় লক্ষ্যমাত্রা বাড়তে পারে। চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে আগামী অর্থবছর সম্ভাব্য ভ্যাট লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে এক লাখ ৫৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ভ্যাট আদায় বাড়াতে প্রতিটি দোকান, শপিংমলে ইএফডি বসানো, ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনা, ভ্যাট আদায়ে এজেন্ট নিয়োগ (ইএফডি বসানো, জরিপ ও তদারকি), ভ্যাট রিটার্ন যাচাই, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভ্যাট আদায়, উৎসে ভ্যাট আদায়ে নিরীক্ষার পরিমাণ বৃদ্ধি, গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি, বকেয়া আদায়, খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত, ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি, বকেয়া ভ্যাট আদায়ে ডেবিট রিকভারি অফিসারের (ডিআরও) ক্ষমতা প্রয়োগসহ বেশ কিছু উদ্যোগের বিষয়ে বাজেটে নির্দেশনা থাকবে। আইএমএফের শর্ত পালনে ডজন খানেক পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা তুলে নেয়া হতে পারে। আর কয়েকটি পণ্যে অব্যাহতির পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হতে পারে। অব্যাহতি তুলে নেয়া হলে বছরে অতিরিক্ত প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বাড়তি ভ্যাট আদায় হবে। তবে কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে অব্যাহতি থাকতে পারে। সিগারেট ও সিমেন্টসহ কয়েকটি পণ্যে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) বাধ্যতামূলক হতে পারে। এতে কয়েক হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় বাড়তে পারে। দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ভ্যাট বসতে পারে।
বাজেটে আয়কর বিষয়ে যেসব উদ্যোগ ও নির্দেশনা থাকতে পারে
এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, রিটার্ন দাখিল বাড়াতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ৩৮টি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ বা পিএসআর বাধ্যতামূলক করা হয়। পিএসআর যাচাই না করলে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারী কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও শাস্তির বিধান করা হয়েছে। এর ফলে চলতি বছর অন্তত ১০ লাখ রিটার্ন বেড়েছে। বেড়েছে কর আদায়। এবার এর সঙ্গে আগামী বাজেটে নতুন আরও ছয়টি সেবা যুক্ত হতে পারে। সেবাগুলো হলোÑস্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও কার্টিজ পেপারের ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে লাইসেন্স নিতে বা তালিকাভুক্তি করতে বা বহাল রাখা, জমি, ভবন এবং অ্যাপার্টমেন্টের ইজারা নিবন্ধন, সব পৌর এলাকায় ১০ লাখ টাকা মূল্যের জমি বিক্রয়, হস্তান্তর বা ইজারা নিবন্ধন, ট্রাস্ট, ফান্ড, ফাউন্ডেশন, এনজিও, মাইক্রোক্রেডিট, সোসাইটি বা সমবায় সমিতির ব্যাংক হিসাব খোলা বা চালু রাখা ও ব্যক্তি কর্তৃক সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ি ভাড়া বা ইজারা গ্রহণকালে এবং বাড়ির মালিকের পণ্য বা সেবা সরবরাহ গ্রহণ। করপোরেট কর কমানো বা বাড়ানো হচ্ছে না।
সূত্রমতে, ধনাঢ্য করদাতাদের সম্পদে সারচার্জ ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাড়তে পারে। বর্তমানে ধনী করদাতাদের সম্পদের ওপর ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। বিশেষ করে আবাসিক সম্পদ ও গাড়ির ওপর এই সারচার্জ দিতে হয়। এ ছাড়া ইনভায়রনমেন্টাল ট্যাক্স নামে একটি নতুন করারোপ হতে পারে। যারা একাধিক গাড়ি ব্যবহার করেন তারা গাড়ির ফিটনেস সনদের সঙ্গে এই কর পরিশোধ করবেন। গাড়ির সিসি ভেদে এই এই করহার নির্ধারিত হতে পারে। আগামী বাজেটে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বার (ই-টিআইএন) বাতিলের সুযোগ দেয়া হতে পারে। অনেকে কোনো কাজে ব্যবহারের জন্য ই-টিআইএন নিয়েছেন। কিন্তু করযোগ্য আয় না থাকায় রিটার্ন দেননি। আবার অনেকে ই-টিআইএন নিয়েছেন কিন্তু বিদেশ চলে গেছেন বা মারা গেছেন। যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে এসব টিআইএন বাতিল বা স্থগিত করা যাবে। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ২৫-২৮ লাখ ই-টিআইএন নিষ্ক্রিদ্ধয় ই-টিআইএন রয়েছে। করযোগ্য আয় না থাকলেও রিটার্ন দাখিল করতে হবে। গত কয়েক বাজেটে রিটার্ন দাখিলে এমন কড়াকড়ি করা হয়। যার ফলে বিপুল পরিমাণ করদাতা শূন্য রিটার্ন দাখিল করে আসছে। তবে এই সুযোগ করযোগ্য অনেক ব্যক্তি শূন্য রিটার্ন দাখিল করে আসছে। এই ফাঁকি রোধে শূন্য রিটার্ন দাখিলে কড়াকড়ি করার চিন্তা করছে সরকার। ফলে আগামী বাজেটে শূন্য রিটার্নের সঙ্গে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর দিতে হতে পারে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে বা মার্জ হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের টিআইএন বাতিল বা স্থগিত করা হতে পারে।
সূত্র আরও জানায়, শত শত কোটি টাকা আয় থাকলেও ট্রাস্ট দেখিয়ে বহু প্রতিষ্ঠান কর দিচ্ছে না। এমনকি রিটার্ন দাখিলও করে না। ট্রাস্টের আয়ের দিকে নজর দেবে সরকার। সে জন্য ট্রাস্টকে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হতে পারে। মূলত দেশের বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টের আওতায় পরিচালিত হয়। করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে সাতে তিন লাখ টাকা হতে পারে। তৃতীয় লিঙ্গের করদাতাদের নিয়োগে প্রতিষ্ঠানকে করছাড় অব্যাহত থাকতে পারে। সবুজ কারখানার করছাড় অব্যাহত থাকতে পারে। দেশে ভারী শিল্প বিকাশ ও বাংলাদেশি ব্র্যান্ড তৈরিতে ‘মেইন ইন বাংলাদেশ’ কর অব্যাহতি সুবিধা বহাল থাকবে। অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টির বিধান বা কালো টাকা সাদা করার সুবিধা বাতিল হতে পারে। চলতি বাজেটে সুযোগ দেয়ার পরও কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নেয়নি। তবে জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিধান চালু থাকবে। করদাতা বাড়াতে এজেন্ট নিয়োগের বিধান চালু হতে পারে। বর্তমানে ইউনিয়ন পর্যায়েও বহু করদাতার করযোগ্য আয় রয়েছে। কমিশনের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া এসব এজেন্ট নতুন করদাতা খুঁজে বের করতে সহযোগিতা করবেন। বর্তমানে ভ্রমণ কর ৫০০ টাকা দিতে হয়। এ কর ৭৫০ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। বর্তমানে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হয় না। এই সীমা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। জ্বালানি তেলের আগাম কর প্রত্যাহার হতে পারে।
বাজেটে কাস্টমস বিষয়ে যেসব উদ্যোগ বা নির্দেশনা আসতে পারে
এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, প্রতিবছর বাজেটে অনেক পণ্যে শুল্ককর কমাতে হয়। আবার কিছু পণ্যে শুল্ককর প্রত্যাহার ও কিছু পণ্যে শুল্ককর বাড়াতে হয়। বিশেষ করে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে সুরক্ষা দিতে শুল্ককর বাড়ানো হয়। বাজেটে ২০০টি শুল্ক লাইনের পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক কমানো হতে পারে। আগামী বাজেটে রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে আসতে পারে শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা। বিদেশ থেকে নতুন প্রযুক্তি নেয়ার ক্ষেত্রে এ ছাড় আসতে পারে। ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটরের দেশীয় উৎপাদকদের উৎপাদন পর্যায়ে রেয়াতি হারে ভ্যাট-সুবিধা আরও এক বছর অব্যাহত থাকতে পারে। বর্তমানে ফ্রিজ-রেফ্রিজারেটরের উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ আছে। দশ বছর ধরে চলে আসা বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণে দেয়া শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার হতে পারে। এই খাতের ১০ শতাংশ শুল্ক সুবিধা তুলে দেয়া হতে পারে। এর ফলে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণের ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন উপকরণ আমদানির ওপর আগের মতো মোট ১১০ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। আমদানিকৃত পণ্য ও কাঁচামালে সিপিসি বা রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার হচ্ছে। অপব্যবহার রোধে নির্দেশনা থাকবে। কিছু পণ্যে রেয়াতি সুবিধা বাতিল হতে পারে।