প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

চাঁদপুর এখন মাদক চোরাচালানের নিরাপদ রুট!

নদীপথ, সড়কপথ ও রেলপথে আসছে মাদক

বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: চাঁদপুর এখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাদক চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। দেশের পূর্বাঞ্চল কিংবা চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর হয়ে অনেকটা নিরাপদে মাদক চলে যাচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজলভ্য হওয়ায় মাদক কারবারিরা এই রুট বেছে নিয়েছে। পাশাপাশি চাঁদপুর জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও মাদক উদ্ধারসহ মাদক কারবারিদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে জানুয়ারি মাসেই চাঁদপুরের বিভিন্ন উপজেলায় বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধারসহ মাদক কারবারিদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে মাদক কারবারিরা চাঁদপুরকে মাদক চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবেই যে ব্যবহার করে আসছে সাম্প্রতিক সময়ে জেলাজুড়ে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধারের ঘটনাতেই তা প্রতীয়মান হচ্ছে।

জানা গেছে, দেশের পূর্বাঞ্চল কিংবা চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর হয়ে মাদক চলে যাচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। এসব মাদকের চালান সাধারণত তিন রুটে বহন করে কারবারিরা। চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কে পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি পুলিশ প্রায়ই অভিযান চালায়। এক্ষেত্রে মাদক কারবারিরা চাঁদপুর শহরের দক্ষিণে হরিণা ফেরি রুট ও ডাকাতিয়া নদী ব্যবহার করছে। এছাড়া চাঁদপুর-লাকসাম রেলপথকেও মাদকচোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক কারবারিরা। ভৌগোলিক কারণে কুমিল্লা বা চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর হয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যেকোনো কিছু পরিবহণ করতে হলে ফরিদগঞ্জ হয়ে হাইমচর কিংবা চাঁদপুর সদরের হরিণা ফেরিঘাট কিংবা হাজীগঞ্জকে রুট হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। হাজীগঞ্জ থেকে নদীপথ, রেলপথ কিংবা সড়কপথে চাঁদপুরে যাওয়া সহজ হওয়ায় মাদক কারবারিরা এ পথগুলো ব্যবহার করছে। বিশেষ করে চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়ক নিরাপদ হওয়ায় তারা এটিকে মাদক পাচারের রুট হিসেবে বেছে নেয়।

অন্যদিকে চাঁদপুর সদরের চান্দ্রা ইউনিয়ন হয়ে হরিণা ফেরিঘাটকে মাদক ও চোরাকারবারিরা নিরাপদ রুট মনে করে মাদক কারবার চালিয়ে আসছে। এই ফেরিঘাট দিয়ে যানবাহনে সড়কপথে এবং ট্রলার কিংবা স্পিডবোটে মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মাদক পাচার হচ্ছে। চাঁদপুর হরিণা ফেরি ঘাট মাদক ও চোরাচালানের বিরাট ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। কক্সবাজার-টেকনাফ ও কুমিল্লা সীমান্ত এলাকা থেকে অতি সহজে বিভিন্ন মাধ্যমে চাঁদপুরে আসছে মাদক ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের চালান। বিশেষ করে চাঁদপুর-শরীয়তপুর ফেরি রুটে অসংখ্য যানবাহন চলাচল করে থাকে। মাদক ব্যবসায়ীরা এ রুটের হরিণা ফেরিঘাটকে অনেকটা নিরাপদ হিসেবে ব্যবহার করছে। বর্তমানে চাঁদপুর-শরীয়তপুর রুটের হানারচর ইউনিয়নের হরিনা ফেরিঘাট যাত্রীবাহী বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনের মাধ্যমে স্থানীয় একটি চক্র কৌশলে দেশের নানা স্থানে ইয়াবাসহ চোরাই পণ্য পাচার করে আসছে।

অপরদিকে পার্শ্ববর্তী জেলা নোয়াখালীর সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে মাদক কারবারিরা চাঁদপুরকেই মাদকের নিরাপদ রুট মনে করে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

সূত্রমতে, গত ২ জানুয়ারি চাঁদপুর কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের বানিয়াচো নামক এলাকা থেকে ৫০ কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করা হয় পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার বাসুরী মোল্লা বাড়ির আলমগীর হোসেনের পুত্র শুভ (২৬) কে। শুভ গাঁজা পরিবহনে সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার (ঢাকা মেট্টো খ-১১-৭১০৬) ব্যবহার করে। পুলিশ প্রাইভেট কারে গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে মাদক কারবারি শুভকে।

৬ জানুয়ারি চাঁদপুর সদর মডেল থানাধীন চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে বরিশাল সিটি করপোরেশন ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কলাডেমা এলাকার মো. নাঈম হোসেন (২০)কে দুই কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চাঁদপুরের রেডিং টিম।

৭ জানুয়ারি বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার ফতেপুর গ্রামের মো. হাবিব মিয়া (২৭)কে চার কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চাঁদপুরের রেডিং টিম।

১২ জানুয়ারি চাঁদপুর সদর মডেল থানাধীন বড় স্টেশন মোলহেড এলাকা থেকে বাগেরহাট জেলার উদয়পুর ইউনিয়নের গাড়কা গ্রামের সালমান চৌধুরী (২৫)কে চার কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চাঁদপুরের রেডিং টিম।

১৩ জানুয়ারি চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে শরীয়তপুর জেলার পালং মডেল থানাধীন দাদপুর গ্রামের কালু সরদার (৪০)কে ১২ কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চাঁদপুরের রেডিং টিম।

১৫ জানুয়ারি বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর লামছড়ি এলাকার দেলোয়ার আখন (৪০)কে দুই কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চাঁদপুরের রেডিং টিম।

১৬ জানুয়ারি হাজীগঞ্জ পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের হাজীগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চসংলগ্ন চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে সরকারবাড়ির পাকা রাস্তার ওপর থেকে ১৫০ পিস ইয়াবাসহ মো. আরিফ হোসেন (৩২), মো. সাইফুল ইসলাম (৩২)-এর কাছ থেকে ১৫০ পিস ও মিঠু (২৬)কে ৫০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিন মাদক ব্যবসায়ীয় বাড়ি হাজীগঞ্জ পৌরসভার মকিমাবাদ গ্রামে।

১৯ জানুয়ারি চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার মেহের স্টেশনসংলগ্ন এলাকা থেকে ৭০ কেজি গাঁজাসহ প্রাইভেট কার জব্দ করে পুলিশ। মাদক কারবারিরা অভিনব কায়দায় মুক্তিযোদ্ধা স্টিকার সাঁটানো সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কারে মাদক বহন করছিল। পুলিশের চেকপোস্ট এড়াতে সংযোগ সড়কে ঢুকে পড়ে। পথে গাড়িটি সামান্য দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে গাড়ির সামনের বাম চাকা ফেটে যায়। এ সময় সামনে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গাড়িতে থাকা মাদক কারবারিরা গাড়িটি কোনো মতে চালিয়ে পশ্চিম উপলতা গ্রামের মেহের স্টেশনের দক্ষিণ পাশে মসজিদের সামনে রেখে সটকে পড়ে। তাৎক্ষণিক পুলিশ গাড়িটি তল্লাশি করে ৭০ কেজি গাঁজা জব্দ করে। চাঁদপুর-কুমিল্লা সড়কের চাঁদপুর সীমানায় যে কটি গাঁজার চালান আটক করা হয়েছে, তার মধ্যে সব মাদক পরিবহন কিংবা মাদক কারবারির বাড়ি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে।

২০ জানুয়ারি চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ফারুক সরদার (২৪) ও লিটন খান (২৫)কে ২ হাজার ৯০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চাঁদপুরের রেডিং টিম।

সর্বশেষ গত ২২ জানুয়ারি হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে হাজীগঞ্জ পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের টোরাগড় এলাকায় থেকে মাদক ব্যবসায়ী সোহেল হোসেন (২৭)কে গাঁজাসহ আটক করে।

বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার ও মাদক কারবারিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (চাঁদপুর সদর সার্কেল) মো. ইয়াসির আরাফাত শেয়ার বিজকে বলেন, বছরের শুরু থেকেই মাদক কারবারি ও মাদক উদ্ধারে বিভিন্ন চেকপোস্ট পরিচালনার জন্য পুলিশ সুপার মহোদয় আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। ফলে চাঁদপুর সদর উপজেলার পাশাপাশি অন্যান্য উপজেলাতেও মাদক উদ্ধারসহ মাদক কারবারিদের আইনের আওতায় আনতে আমরা সক্ষম হচ্ছি। চাঁদপুরের যেসব পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকে, সেসব স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে আছে। প্রতিনিয়ত ধরাও পড়ছে। আসলে যারা এসব কাজ করে, তারা দিনদিন তাদের মাদক পাচারের কৌশল পরিবর্তন করে থাকে। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

কচুয়া সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, আপনাদের সহযোগিতায় জনগণকে সার্বিক নিরাপত্তা ও সহায়তায় মাদক, ইভটিজিং, বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, জঙ্গিবাদÑযেকোনো অপরাধ নির্মূল করতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাজীগঞ্জ সার্কেল) পংকজ কুমার দে শেয়ার বিজকে বলেন, মাদক কারবারিরা বিভিন্ন সময়ে মাদক পরিবহনের পদ্ধতি বদলে অভিনব পদ্ধতিতে মাদক পরিবহন ও ব্যবসা পরিচালনা করে। আমরাও তাদের গতিবিধির ওপর নজরদারির মাধ্যমে মাদক নির্মূলের লক্ষ্যে কাজ করছি। আমাদের পুলিশ সদস্যদেরও নির্দেশনা দেয়া আছে। আমরা মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার বলেই মাদক ব্যবসায়ীসহ মাদক উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চাঁদপুরের মহাপরিচালক মো. এমদাদুল হক মিঠুন শেয়ার বিজকে বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে আমরা মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছি। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।