নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদে অনন্য দেশি কৈ-শিং-মাগুর। তবে বিলুপ্তিতে এসব দেশি পদের আধিক্য বাজারে কমছে। উল্টো দিকে বাড়ছে নানা প্রজাতির চাষের মাছ। এতে দুই পদের মাছের দামের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। দেশি পদের মাছ বাজারে এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। সে ঘাটতি পূরণ হচ্ছে চাষের মাছে। নি¤œবিত্তসহ মধ্যবিত্তের প্রতিদিনের আমিষের চাহিদা পূরণের ভরসা এখন এসব মাছ।
কারওয়ান বাজারে শিং ও দেশি মাগুর মাছ কিনে ক্রেতা শরিফুল আলম অনেকটা আক্ষেপ করে বলেন, শিং-কৈ-মাগুর তো সবই চাষের। আর দেশি হলে দামের কারণে হাত দেওয়া যায় না। এসব দেশি পদ আমাদের কেনার সাধ্য নেই। আমরা চাষের মাছে খুশি থাকি। শেওড়াপাড়া বাজারে ক্রেতা রিকশাচালক লিটন খন্দকারও বললেন এমনটাই। তার ভাষায় চাষের মাছের কারণে তো মাছ মুখে উঠছে। মাত্র ১৪০ টাকায় ১ কেজি কৈ মাছ পাওয়া যায়। ১২০ টাকায় সিলভারকাপ। গরিবরা এসবই খায়। ওই বাজারের বিক্রেতা গৌতম বাবু বলেন, বাজারে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত প্রায় সবাই চাষের মাছ আর হাইব্রিড মাছ কিনে। স্বাদে কম হলেও দামের কারণে এসব মাছ এখন জনপ্রিয় হচ্ছে।
রাজধানীর মাছের আড়ত কারওয়ান বাজারের মৎস্য আড়ত মালিক সমিতির (পাঁচ তারা) সভাপতি কামাল হোসেনের মতে, কারওয়ান বাজারের সকালে যে পরিমাণ মাছ আড়তগুলোতে বিক্রি হয়, তার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই আসছে বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা খামার থেকে। তার হিসেবে, কারওয়ান বাজারে চার শতাধিক মাছের আড়তের মধ্যে একশোটির মতো আড়ত ইলিশ ও অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ বিক্রি করে। বাকি আড়তগুলোর মধ্যে হাতেগোনা ডজন খানেক আড়তে দেশি পদের মাছ আসে। বাকি সবাই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাষের মাছ সংগ্রহ করে রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারের বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন।
বাজারে চাষের মাছের আধিক্য নিয়ে তার দেওয়া এমন তথ্যের প্রমাণ মেলে মৎস্য অধিদফতরের তথ্যেও। অধিদফতরের হিসেবে, বিগত ১০ বছরে মাছের উৎপাদন যা বেড়েছে, তার ৭৬ শতাংশই আসছে পুকুর ও জলাশয়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা। নব্বই দশকে দেশে চাষ করা মাছ উৎপাদিত হয়েছিল এক লাখ ৯৩ হাজার টন। ২০০০ সালে তা বেড়ে ছয় লাখ ৫৭ হাজার এবং ২০১৫-তে এসে তা ১০ লাখ টন ছাড়িয়েছে।
জানতে চাইলে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাহের শেয়ার বিজকে জানান, দেশে নব্বই দশক থেকে রুই, পাঙাশ, তেলাপিয়া ও সিলভার কাপের মতো মাছ বাণিজ্যিক চাষ বেশি হতো। তবে গত তিন বছর ধরে কৈ, টেংরা,পাবদা, শিং, গুলশার মতো ১৪ জাতের মাছের উন্নত চাষ কৌশল উদ্ভাবন হয়েছে, যা চাষিরা অনুসরণ করে উৎপাদন বাড়িয়েছেন। এতে বাজারে এসব পদের আধিক্য বেড়েছে।
এদিকে বিভিন্ন গবেষণায় বলছে, বিগত ৩০ বছরের ব্যবধানে দেশীয় ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৫ প্রজাতির মাছ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফলি, বামোশ, টাটকিনি, তিতপুটি, আইড়, গুলশা, কাজলী, গাং, মাগুর, কুচিয়া, নামা চান্দা, মেনি, চেং, কালি বাউশ, ঢেলা, পাবদা, টেংরা, কানি পাবদা, মধু পাবদা, শিং, চেকা, কৈ, গচি, সরপুঁটি, শোল, রিটা, পাঙাশ, বাঘা আইড়, বোয়াল, চিতল, গড়াই মাছ।
এদিকে বাজারের বিক্রেতারা বলছে, বর্তমানে বাজারে হাইব্রিড জাতের সিলভার কার্প, গ্লাস কার্প, মিরর কার্প, কমন কার্প, ব্ল্যাক কার্প, বিগহেড, থাই সরপুঁটি, থাই কৈ, থাই পাঙাশ, আফ্রিকান মাগুর, হাইব্রিড টেংরা, হাইব্রিড রুই, তেলাপিয়া মাছ আমদানি হচ্ছে। চাষ করা হাইব্রিড ও দেশি প্রজাতির মাছের দামের পার্থক্য ক্রমেই বাড়ছে। কোনো ক্ষেত্রে তা দ্বিগুণেরও বেশি। বাজারে যেখানে এক কেজি দেশি কৈ ৪৫০ টাকার, সেখানে বর্তমানে চাষ করা কৈ ১২০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
গতকাল রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরেও দেখা গেল এমন চিত্র। বাজারে যেখানে দেশি রুই, কাতল মৃগেল মাছের দাম ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি, সেখানে ওইসব জাতের চাষ করা হাইব্রিড মাছ মিলছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়। চাষ করা মাগুর, শিং, টেংরা মিলছে ৩০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা, সিলভারকাপ, তেলাপিয়া, পাঙাশ, সরপুঁটি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে।
এদিকে চাষের মাছের আধিক্যের সুবিধা মিলছে ভোক্তাদেরও। প্রতিদিনের আমিষের চাহিদা পূরণে সার্বিকভাবে মাছ ক্রয়ে খরচ কম বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশে রুই মাছের দাম তেমন বাড়েনি। বরং কই, পাঙাশ, কাতলা ও চিংড়ির দাম কমেছে।