নাজমুল হুসাইন: দেশে এখন ১০ শতাংশেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। তবে এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি সেবার সুযোগ একেবারেই অপ্রতুল। সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য মাত্র ৮২টি পৃথক শয্যা রয়েছে। শুধু তাই নয়, সারা দেশের হাসপাতালগুলো চলছে এ রোগের মাত্র ৪০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) জানায়, দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের একেবারেই সুুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ধরা হয়, বর্তমানে গ্রামে আট শতাংশ ও শহরে ১০ শতাংশ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। সে হিসাবে জনসংখ্যা ও আক্রান্তের হার দেড় কোটির বেশি। তবে প্রায় অর্ধেক রোগীর এ তথ্য জানা নেই।
আরেক হিসাবে শুধু বারডেম, ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্ক (এনএইচএন), হেলথকেয়ার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এইচসিডিপি) ও অধিভুক্ত সারাদেশের সমিতিতে এখন ৩৫ লাখের বেশি নিবন্ধিত ডায়াবেটিস রোগী রয়েছেন। যারা নিয়মিত এসব প্রতিষ্ঠান থেকে রোগের চিকিৎসা নেন। বাকি প্রায় অর্ধেক তাদের রোগ সম্পর্কে অসচেতন বা অন্যান্য চিকিৎসা নেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় ৫০ হাজার শয্যার মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মাত্র ৮২টি পৃথক শয্যা রয়েছে, যার প্রায় সবগুলো বড় হাসপাতালে। মোট আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ১৩টি শয্যা। আর সারা দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৪০ জন। এতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত গোষ্ঠীকে ভরসা করতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ওপর। আর অধিক ব্যয়, ভোগান্তি ও অপ্রতুল চিকিৎসার কারণে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ছে অনেকেই।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের প্রধান ডা. রুহুল আমিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ডায়াবেটিসের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল না থাকায় একদিকে যেমন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কাজ করতে পারছেন না, অন্যদিকে অন্যান্য রোগের মতো ডায়াবেটিসের বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার কম সাধারণ মানুষের। সরকার যেহেতু চিকিৎসা খাতে আন্তরিকভাবে কাজ করছে, তাতে এ বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া উচিত’ বলে মনে করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এলেও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় তার চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয় না। সে সময় সরকারি পর্যায়ে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা অপ্রতুল থাকায় রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠাতে হয়। এছাড়া বারডেমে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ডসহ অন্যান্য হাসপাতালে কয়েকজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ থাকলেও পর্যাপ্ত সেবার ব্যবস্থা এবং আসন না থাকায় চিকিৎসা পান না রোগীরা।
চলতি বছর আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বের মধ্যে দশম অবস্থানে বাংলাদেশ। আক্রান্তের এ হার অব্যাহত থাকলে ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে পৌঁছাবে।
অপরদিকে, ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে যত লোকের মৃত্যু হয়, তার ৫৯ শতাংশই হয় অসংক্রামক ব্যাধির জন্য। এর মধ্যে ১৭ ভাগ হƒদ?রোগ ও স্ট্রোকে, ১১ ভাগ ফুসফুসের জটিলতায়, ১০ ভাগ ক্যানসারে ও এককভাবে ডায়াবেটিসে তিন ভাগ। অন্যান্য অসংক্রামক ব্যাধিতে মারা যায় ১৮ ভাগ।
বাডাস সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশনের পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে গত বছর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭১ লাখ। অথচ তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের কোনো ধারণাই নেই যে, তারা ইতোমধ্যেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। গত বছর দেশে এক লাখ ২৯ হাজার ৩১৩ জনের মৃত্যু ঘটেছে ডায়াবেটিসজনিত কারণে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে একত্র হয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। মানুষ সচেতন না হলে আক্রান্তের হার কোননোভাবেই কমবে না। এটা মহামারী হয়ে দাঁড়াবে।
অপরদিকে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের জাতীয় পর্যায়ের সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ অনুসারে দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১১ শতাংশ নারী-পুরুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আক্রান্তদের হার শহরে বেশি। এছাড়া ২৫ শতাংশ নারী ও পুরুষ প্রাক-ডায়াবেটিস পর্যায়ে আছে। অর্থাৎ তাদের রক্তে শর্করা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি।
এদিকে দেশে মানসম্পন্ন ডায়াবেটিস চিকিৎসা বড় চ্যালেঞ্জও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মানসম্পন্ন সেবার জন্য একজন রোগীর পেছনে বছরে কমপক্ষে ২৮ মার্কিন ডলার খরচ করা দরকার। এতে বাংলাদেশের এই বিশালসংখ্যক মানুষকে মানসম্পন্ন সেবা দিতে হলে স্বাস্থ্য বাজেটের বড় অংশ শুধু ডায়াবেটিস খাতেই রাখতে হবে।