প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

চিকিৎসা সেবার যত ত্রুটি ও উন্নয়নে করণীয়

আজকাল চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে প্রশ্ন বেশি উঠছে। আমরা প্রায়ই দেখে থাকি কিংবা শুনে থাকি চিকিৎসকের অবহেলা, ভুল অপারেশন, ভুল চিকিৎসা, ভুল পদ্ধতি, হয়েছে এক অসুখ, চলছে আরেক অসুখের  চিকিৎসা, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, অস্ত্রোপচারে অদক্ষতা ইত্যাদি কারণে অনেক রোগী তাদের জীবন হারাচ্ছেন এবং অনেক ডাক্তার অভিযোগের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এর কারণে অনেক গোলযোগের সংবাদও আমরা শুনে থাকি। এর সূত্র ধরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভুক্তভোগীর আত্মীয়স্বজনদের মারামারি এ আর নতুন কী? আসলে এ বিষয়গুলো দ্রুত যথার্থ পদক্ষেপের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, না হলে প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

জীবন তো কোনো ছেলেখেলা নয়। চিকিৎসাক্ষেত্রে কোনো ধরনের অবহেলা কাম্য নয়। আমরা কি বলতে পারি তাহলে ভুল চিকিৎসা হচ্ছে? নাকি ডাক্তারে ডাক্তারে দলাদলি আছে? নাকি পর্যাপ্ত পরিমাণ মনিটরিং হচ্ছে না হাসপাতালগুলোয়? নাকি খতিয়ে দেখার বিষয়টি আরও আগে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হতো? আসলে আমরা যারা ডাক্তার না, তারা পুরোপুরি একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারি না। কখনও এটা কারণ মনে হয়, কখনও ওটা কারণ মনে হয়। যদিও ডাক্তাররা সবসময় দোষী হন না। অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির কারণে তাদের অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়। আমরা অভিযোগ করব সেখানে যেখানে অভিযোগ করলে পরবর্তীতে ওই কাজটি আর হবে না কিন্তু কোথায় সে ব্যবস্থা? আমাদের ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। দেশে বড় বড় হাসপাতাল রয়েছে।আগের চেয়েও যদিও বা উন্নতি সাধন হয়েছে চিকিৎসাব্যবস্থায়।  দেশের রয়েছে বিশেষায়িত অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যা উন্নত বিশ্বের মতো। সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আদলে আগারগাঁওয়ে তৈরি হয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতাল।

প্লাস্টিক, নিউরো, কিডনি, চক্ষু, হƒদরোগসহ বিভিন্ন বিষয়ের চিকিৎসকগণ প্রতি বছর অবসরে যাচ্ছেন। এ কারণে প্রতি বছর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব তৈরি হচ্ছে। দক্ষ জনবলের অভাবে এ পর্যায়ে যন্ত্রপাতিগুলো অব্যবস্থায় থাকতে থাকতে একপর্যায়ে অকেজো হয়ে পড়ে। যার ফলে রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই যেমন-মালয়েশিয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। এছাড়া ফ্রান্স, থাইল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশগুলো অবকাঠামোগত দিক থেকে অনেক উন্নত এবং চিকিৎসাসেবার মানও চোখে পড়ার মতো তাইতো দেশের তথাকথিত ভিআইপিরা সেসব দেশে পাড়ি জমায় শরীরের কোনো সমস্যা হলেই।

প্রশ্ন জাগে কেন দেশের ভেতরেই এমন ব্যবস্থা নেই? দেশের সরকারি হাসপাতালে প্রায় সবাই চিকিৎসা গ্রহণ করেন, বেসরকারিগুলোতে তো এত খরচ তা সামলানো সম্ভব হয় না অনেক মানুষের পক্ষে। সরকারিগুলোতে ডাক্তাররা কোনোরকমভাবে দেখে প্রাইভেট হাসপাতাল খুলতে বেশি আগ্রহী ও মনোযোগী এটা দেখা যায়। সুইজারল্যান্ডে স্বাস্থ্যসবা মূল্যায়িত হয় সিস্টেম বিমার ওপর ভিত্তি করে, ইতালিতে জাতীয় বিমা ও বার্ষিক পারিবারিক আর্থিক সক্ষমতা কাঠামো অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় নির্ধারণ হয়। ইউরোপীয় দেশগুলোর যেকোনো নাগরিক নিজের স্বাস্থ্য বিমা ব্যবহার করে যেকোনো দেশের উন্নত চিকিৎসা নিতে পারেন। ইউরোপে স্বাস্থ্যসেবাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে দেখা হয়। ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে ভেতরে ভেতরে যুদ্ধ চলে কে বেশি সেবা দিতে সক্ষম এই নিয়ে।

আমাদের দেশে রাজধানী থেকে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যন্ত হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাসেবা মনিটরিং করার জন্য কমিটি রয়েছে। সবার উপরে থাকেন স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক, তার নিকট পুরো দেশের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমের তথ্য থাকে এবং সে অনুযায়ী তিনি ব্যবস্থাও নিয়ে থাকেন। উপজেলা পর্যায়ে থাকেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা। জেলা পর্যায়ে থাকেন সিভিল সার্জন, তার পুরো জেলার চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম মনিটরিংয়ের দায়িত্ব। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেন, রাজধানীর হাসপাতালগুলো সরাসরি মনিটরিং করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক, তাছাড়া অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত মনিটরিং করা হয় না। বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো কীভাবে চলে তার কিছুই মনিটরিং করা হয় না। আসলে এমন অনেক ছোট শহর আছে যেখানকার মানুষ সক্ষমতানুযায়ী  অসুস্থ হলে রাজধানীতে চলে আসে। কেননা সেই জায়গায় উন্নত যন্ত্রপাতি নেই, চিকিৎসার উপযুক্ত মানের অভাব রয়েছে কিন্তু তাদের সামর্থ্য নেই তারা কী করবেন? তাদের সুচিকিৎসার ভার কে বহন করবেন?

আবার যেখানে অবকাঠামো উন্নত, উন্নত যন্ত্রপাতি আছে সেখানেও যে সবসময় সুচিকিৎসা হয় তাও না। উন্নত যন্ত্রপাতি থাকলেও তা পরিচালনার জন্য দক্ষশক্তি অপ্রতুল। কেন সব জায়গায়, সর্বাবস্থায় সবার সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে? সব হাসপাতালে উন্নত অবকাঠামো ও উন্নত যন্ত্রপাতি থাকা আবশ্যক এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যথাযথ দক্ষশক্তি দরকার।

চিকিৎসার বিকল্প অনেক অসুখের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহƒত হচ্ছে তেমন: এলোপ্যাথির পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক। সেক্ষেত্রে এগুলো থেকে যদি সুফল পাওয়া যায় তাহলে এই বিকল্প ব্যবস্থাগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে এবং তা প্রয়োগে জোর দিতে হবে। সর্বোপরি ওষুধ প্রয়োগে চিকিৎসাকের যথেষ্ট সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে এবং উন্নতদেশগুলোর মতো চিকিৎসাসেবার মানকে উন্নত করতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে, নাহলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে বা সুচিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারাবেন। এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে, যা দ্রুত নির্মূল করা প্রয়োজন।

বন্যা রানী মহন্ত

শিক্ষার্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়