রহমত রহমান: বেশি কাঁচামাল রয়েছে, এমন অভিযোগে চালান খালাস স্থগিত করা হয়। শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয় দুবার। তবে বেশি কাঁচামাল পাওয়া যায়নি, কিন্তু বেরিয়ে আসে প্রাপ্যতা জালিয়াতির ভয়ংকর তথ্য। প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্ত না থাকার পরও লাইসেন্সে জালিয়াতি করে পৃষ্ঠা সংযোজন করে পণ্য খালাসের চেষ্টা করা হয়। একটি প্রাপ্যতা জালিয়াতিতে শুল্ককর ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় চার কোটি ৩৪ লাখ টাকা। জালিয়াতি প্রমাণিত হওয়ায় দেয়া হয়েছে আট কোটি ৭০ লাখ টাকা। কিন্তু একটি প্রাপ্যতা জালিয়াতির রহস্য উদ্ঘাটনের সময় বেরিয়ে আসে একে একে আরও ৪৪টি প্রাপ্যতা জালিয়াতির তথ্য, যাতে শুল্ককর ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা। টাং ফ্যাশন লিমিটেড নামে চীনের একটি তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রাপ্যতা জালিয়াতির রহস্য উদ্ঘাটন করেছে কাস্টমস। এটি নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেড এলাকার শত ভাগ রপ্তানিকারক ও বন্ডেড প্রতিষ্ঠান। তবে প্রতিষ্ঠান প্রাপ্যতা জালিয়াতির দায় নিজের কাঁধে না নিয়ে প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, আমদানিকারক টাং ফ্যাশন লিমিটেড চীন থেকে এক লাখ ৬৩ হাজার ৪৭২ কেজি বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের চালান আমদানি করে। ২০২২ সালের ২ আগস্ট পণ্য চালান খালাসে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নভো কার্গো সার্ভিসেস লিমিটেড বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। ঘোষণার তুলনায় অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চালানটির খালাস স্থগিত করে। পরে চালানটি শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। এতে পলিয়েস্টার ফেব্রিক্স ঘোষণার চেয়ে চার হাজার ৫২১ কেজি এবং ১৮ হাজার ৬১৬ কেজি ইকো ভিসকস ফেব্রিক্স বেশি পাওয়া যায়। পরে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাস্টম হাউসে প্রতিবেদন দেয়া হয়।
সূত্র আরও জানায়, কাস্টম হাউস অনলাইন থেকে প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স কপি ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের দাখিল করা প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্সের কপি যাচাই করে গরমিল পায়। পরে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে প্রতিষ্ঠানের সত্যায়িত বন্ড লাইসেন্স কপি সংগ্রহ করে আবার যাচাই করে। এতে দেখা যায়, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের দাখিল করা বন্ড লাইসেন্সের কপির ৬ ও ৭ নম্বর পৃষ্ঠা জালিয়াতি করে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত পণ্য আমদানি করে আসছে। অর্থাৎ প্রাপ্যতা জালিয়াতি করে প্রতিষ্ঠান নিয়মিত পণ্য আমদানি করে আসছে। পরে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থেকে প্রতিষ্ঠানের আমদানি তথ্য যাচাই করা হয়। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান এর আগে ৪৪টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে প্রাপ্যতা জালিয়াতি করে পণ্য আমদানি করে খালাস নিয়েছে। আমদানি করা পণ্যের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ১২ কোটি চার হাজার ৪৮৬ টাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ১০ কোটি ৬৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৫২ টাকা।
অন্যদিকে জালিয়াতির বিষয়ে ১৬ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়। ২৪ নভেম্বর প্রতিষ্ঠান লিখিত জবাবে পণ্য চালানটি আবার কায়িক পরীক্ষার দাবি জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ নভেম্বর পণ্য আবার কায়িক পরীক্ষা করা হয়। এতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ঘোষণার চেয়ে সামান্য পরিমাণ কাপড় বেশি পাওয়া যায়। ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জাং য়িং ও মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া শুনানিতে অংশ নেন। লিখিত বক্তব্যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বন্ড লাইসেন্সের ৬ ও ৭ পৃষ্ঠা প্রতিষ্ঠানের একজন বাণিজ্যিক কর্মকর্তা জালিয়াতি করেছেন। কর্মকর্তা নিজ উদ্যোগে জাল দলিল তৈরি করে সিঅ্যান্ডএফকে প্রদান করেছেন। এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠান জড়িত নয়। ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অপরদিকে ৪৪টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি করা কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। তবে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠা চালানটি ঘোষণা অনুযায়ী সঠিক পাওয়া গেছে।
সূত্রমতে, প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র, লাইসেন্সের জালিয়াতি করা কপি ও প্রতিষ্ঠানের জবাব পর্যালোচনা করে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি রায় দেন চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান, যাতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠান বন্ড লাইসেন্সের সঙ্গে ৬ ও ৭ নম্বর পৃষ্ঠা সংযুক্ত করে জালিয়াতির মাধ্যমে বন্ডের আওতায় একটি পণ্য চালান খালাসের চেষ্টা করেছে। আমদানি করা পণ্যের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য চার কোটি ৮৬ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৭ টাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর চার কোটি ৩৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৫ টাকা। আমদানি করা পণ্যের বর্ণনা ও এইচএস কোড বন্ড লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্ত না থাকার পরও জালিয়াতির মাধ্যমে বন্ডের আওতায় পণ্য খালাসের চেষ্টা করেছে আমদানিকারক। জালিয়াতির মাধ্যমে অসত্য ঘোষণায় পণ্য আমদানির অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা পণ্য রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানকে আট কোটি ৭০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়। তবে পণ্যগুলো অবাধে আমদানিযোগ্য হওয়ায় বাজেয়াপ্তের পরিবর্তে ছাড়করণে ১০ লাখ টাকা বিমোচন জরিমানা আরোপ করা হয়। যথাযথ এইচএস কোডে শ্রেণিবিন্যাস, প্রযোজ্য শুল্ককর, অর্থদণ্ড ও বিমোচন জরিমানা পরিশোধ এবং আমদানি নীতির শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে পণ্য খালাসের আদেশ দেয়া হয়। তবে প্রযোজ্য শুল্ককর, অর্থদণ্ড ও বিমোচন জরিমানা পরিশোধ করা না হলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাস্টমস আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আদেশে বলা হয়।
শুল্ক গোয়েন্দার আটক করা পণ্যে প্রাপ্যতা জালিয়াতির বিষয়টি অস্বীকার করেন টাং ফ্যাশনের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। একইসঙ্গে আগের ৪৪টি বিল অব এন্ট্রিতে প্রাপ্যতা জালিয়াতির বিষয়টিও অস্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘প্রাপ্যতা জালিয়াতি করলে কি আর পণ্য বের হতো? তাহলে তো এখন যেভাবে আটক করেছে, সেভাবে আটকাত। জালিয়াতি যেটা পেয়েছে, সেটা নিয়ে আমাদের আইনজীবী মুভ করছেন।’ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস প্রতিষ্ঠানকে শুল্ককর ফাঁকিতে যে অর্থদণ্ড দিয়েছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার বলার মতো কিছু নেই, কারণ যা হয় আমাদের আইনজীবী ফেস করবেন। কী হবে না হবে, তা নিয়ে আলোচনা করে আমাদের আইনজীবী কাজ করছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যে মাল আমদানি করেছি, তা আমরা রপ্তানি করেছি। এতে চলচাতুরীর কিছু নেই, এটাই আমরা প্রমাণ করব।’ ৪৪টি প্রাপ্যতা জালিয়াতি করা হয়েছে কি নাÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না, এমন কিছু নয়। যা কাস্টমস লিখছে, তা আমরা প্রমাণ করব যে, এখানে ছলচাতুরীর কিছু নেই। প্রমাণ করার জন্য আমরা আইনজীবীর শরণাপন্ন হয়েছি।’